প্রাচীন শিল্পকলার অনন্য নিদর্শণ মধ্যপ্রদেশের বাঘগুহা
- আপডেট সময় : ০৪:৫১:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪ ২২৬ বার পঠিত
বাঘ গুহা, মধ্যপ্রদেশ, ভারত
বাঘ গুহার বর্তমান অবস্থান মধ্যপ্রদেশের ধর জেলায়। বাঘ নামক গ্রামের নাম থেকেই গুহাটির এইরূপ নামকরণ। নিকটস্থ বাঘ বা বাঘিনী বা ওয়াগ নদীর নাম থেকে গুহাটির নাম হয়েছে বাঘ বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। বিন্ধ্য পর্ববতের দক্ষিণ ঢালের মধ্যে অবস্থিত। বিন্ধ্য পাহাড় কেটেই বাঘ গুহাগুলি তৈরি করা হয়েছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভগুলি (স্মৃতিমন্দির) ধর শহর থেকে ৯৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এগুলি প্রাচীন ভারতের গুণী চিত্রশিল্পীদের ম্যুরাল পেইন্টিংয়ের জন্য বিখ্যাত। অন্য কথায় বাঘ গুহা ভারতীয় শিলা-কাটা (রক কাটিং) স্থাপত্যের উদাহরণ।
পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মহু-এর কাছে বাগ গুহাগুলি বৌদ্ধ বিষয়ের উপর আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে, যা মোটামুটিভাবে ৫ম শতাব্দীর। প্রায় একই সময়কাল (৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দী) থেকে উদ্ভূত হয়েছিল উদয়গিরি গুহা (ব্রাহ্মণ্য ও জৈন মঠ), বিদিশার কাছে সাঁচির বৌদ্ধ স্তূপ।
মহারাস্ট্রের অজান্তা এবং মধ্যপ্রদেশের বাঘ দু’টির সম্পর্ক নিবিড় ও দূর্গম অরণ্যবেষ্টিত। এই দুই গুহারই সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষুদ্র খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। অজন্তার চিত্রকর্ম ধর্মীয় বিষয় দ্বারা অনুপ্রাণিত কিন্তু বাঘ গুহাচিত্রগুলি বৌদ্ধ চিত্রকলার পাশাপাশি লৌকিক জীবনের সাথেও সম্পর্কিত। বাঘ গুহার ফ্রেস্কোচিত্র অজান্তার বিপরীতে অঙ্কিত। বাঘের গুহাগুলি নির্মিত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে নবম সতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন রাজা ও বৃত্তবানদের পৃষ্ঠপোষকতায়। স্যার জন মার্শাল বলেছেন যে, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় চিত্রের সঙ্গে বাঘ গুহার চিত্রের তুলনা চলে।
মহারাজা সুবন্ধুর একটি তাম্রলিপি, বিহারের মেরামতের জন্য তাঁর দান লিপিবদ্ধ করে গুহা ২-এর স্থানে পাওয়া গেছে। যদিও, বাঘের শিলালিপির তারিখটি অনুপস্থিত, তার বাডওয়ানি তাম্রশাসনের শিলালিপিটি ১৬৭ সালে (গুপ্ত যুগের) তারিখের।
বাগ গুহাগুলি খ্রিস্টীয় ৫-৬ষ্ঠ শতাব্দীতে, ভারতে বৌদ্ধধর্মের একেবারে শেষ পর্যায়ে এবং বেশিরভাগ ভারতীয় বৌদ্ধ গুহা নির্মাণের অনেক পরে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা ১ম শতাব্দী থেকে। এগুলি ৫-৭ম শতাব্দীতে নির্মিত বলে মনে করা হয়। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে জায়গাটিকে পুনরুদ্ধার করেছে। বাঘ গুহার একটি প্রাচীন চিত্রের নিচে প্রায় মুছে যাওয়া একটি লেখা থেকে ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেন যে, প্রাচীন চিত্রটি নবম শতাব্দীর গুহাচিত্র।
এই গুহাটিতে বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র শহর থেকে সহজেই যাওয়া যায়। বাঘানি নদীর তীরে একটি পাহাড়ের লম্ব বেলেপাথরের মুখে দক্ষ কারিগরদের দ্বারা খনন করা (খোদাই) হয়েছিল। বৌদ্ধদের অনুপ্রেরণায় নয়টি গুহার মধ্যে মাত্র পাঁচটি টিকে আছে। এগুলি সবই ‘বিহার’ বা সন্ন্যাসীদের বিশ্রামের স্থান যেখানে চতুষ্কোণ পরিকল্পনা রয়েছে। একটি ছোট কক্ষ, সাধারণত পিছনে, ‘চৈত্য’, প্রার্থনা কক্ষ গঠন করে। এই পাঁচটি বিদ্যমান গুহার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল গুহা ৪, সাধারণত রং মহল (রঙের প্রাসাদ) নামে পরিচিত।
বাঘের গুহা সংখ্যা মোট নয়টি প্রতিটি গুহায় বৌদ্ধ বিহার। এই গুহাচিত্র কলাটি ১৮১৮ সালে লেফটেন্যান্ট ডেঞ্জার ফিল প্রথম আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে ১ নম্বর গুহাটির কোন অস্তিত্ব নেই। ২, ৩ এবং ৪ নম্বর গুহাতে বর্তমানে প্রবেশ করা যায়। ছয় থেকে নয় নম্বর গুহা প্রায় পরিত্যক্ত। ২ নম্বর এবং ৪ নম্বর গুহা জনপ্রিয় বৌদ্ধ বিহার। তিন নাম্বার গুহা শ্রমণদের বাসগৃহ ছিল। যাকে হাতিখানা বলা হয়।
গুহা নম্বর ২ হল সেরা সংরক্ষিত গুহা, যা “পান্ডব গুহা” নামেও পরিচিত। এই চিত্রগুলি আধ্যাত্মিক নয় বরং বস্তুবাদী। চিত্রকর্মের বৈশিষ্ট্য অজন্তা গুহার মতো। দেওয়াল ও ছাদে বিছিয়ে দেওয়া মাটির তৈরি লালচে-বাদামী আঁশটে এবং পুরু মাটির প্লাস্টার। প্লাস্টারের উপরে, চুন-প্রাইমিং করা হয়েছিল, যার উপর এই চিত্রগুলি চালানো হয়েছিল। গুহা ৪এর পোর্টিকোর দেয়ালে সবচেয়ে সুন্দর কিছু পেইন্টিং ছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় শিল্পের মূল্যবোধের আরও ক্ষতি রোধ করার জন্য, বেশিরভাগ চিত্রগুলি ১৯৮২ সালে সাবধানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং আজ গোয়ালিয়রের গুজারি মহল প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে দেখা যায়।
পাঁচ নম্বর গুহাটি সুমনদের আহারাদি গ্রহণে ও উপদেশদানের স্থান রূপে ব্যবহৃত হতো। চার নম্বর গুহাটির চিত্র সর্বাপেক্ষা চিত্রাকর্ষক। চার নম্বর গুহাটির নাম রঙমহল। এছাড়াও পাণ্ডব গুহাটিও খুবই জনপ্রিয়। পাণ্ডব গুহাতে পদ্মপানে বুদ্ধের ছবি খোদাই করা আছে। স্যার জন মার্শাল, মুকুল দে, অসিত কুমার হালদার প্রমুখ ৪ নম্বর গুহা তথা রংমহলের প্রাচীর চিত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। বাঘ গুহার চিত্র মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। ৪ নং গুহাতে একজন পুরুষকে ঘিরে নারীদের নৃত্য দৃশ্য খুবই আকর্ষণীয়। যেটি উজ্জ্বল রঙে আঁকা হয়েছিল। নারী-পুরুষের এই বৃত্তাকার নৃত্যকে হল্লীসক নৃত্য বলা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা থেকে হল্লীসক নৃত্যের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। ভারতীয় নৃত্যকলা ও সংগীতের এই রূপ দৃশ্য গুপ্ত যুগ ও বাকাটক যুগে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
বাঘ গুহার চিত্রশিল্পীগণ হাতি ও ঘোড়ার ছবি অঙ্কনে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শোভা যাত্রার দৃশ্যে হাতি, ঘোড়া দেখা যায়। বাঘ গুহার চিত্র মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্ম সংক্রান্ত চিত্র ব্যতিত সামাজিক ঘটনাবলীর প্রাধান্য এখানে পরিলক্ষিত হয়। উৎসবের চিত্রটি থেকে প্রাচীনকালের শিল্পীর অবাধ স্বাধীনতা ও অপূর্ব অংকন ছাতুর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বাঘের চিত্রগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, এখানে শিল্পীগণ ধর্ম সংক্রান্ত তথা বুদ্ধদের জাতক সংক্রান্ত কাহিনী ও ঘটনার বৃত্ত পেরিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছেন। অজান্তা চিত্রে যা নাই, বাঘের চিত্রে আছে সেই আলো-ছায়ার খেলা। পরিকল্পনা, বর্ণ সুষমা ও বাস্তবতার দিক থেকে বাঘ গুহার চিত্র বাস্তবিকই অতুলনীয়।