সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড অফিসার তারেকুল ইসলাম, নাবিক সাজ্জাদ হোসেন ও অয়েলার কর্মকর্তা শামসুদ্দিন শিমুল বাড়ি ফিরেছেন। তৌফিক ও তারেকুল বুধবার সকালে, সাজ্জাদ ও শিমুল মঙ্গলবার রাতে বাড়ি পৌঁছান। তাদের ফিরে পেয়ে যেন আবেগের বাঁধ ভেঙে যায় পরিবারের সদস্যদের।
গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার ২০/১ করিমনগর এলাকার বাড়িতে পৌঁছান তৌফিক। এ সময় তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, দুই ভাই, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এলাকার লোকজন ফুল দিয়ে স্বাগত জানান তৌফিককে।
তৌফিকের বাবা মো. ইকবাল বাড়িতে আসা লোকজনকে মিষ্টি খাওয়ান। পরে তৌফিক সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন প্রায় এক মাস জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা অবস্থার সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। কৃতজ্ঞতা জানান জাহাজ মালিক ও সরকারের প্রতি।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন খুবই ভালো লাগছে। জিম্মি থাকাকালীন আমাদের চেয়ে আমাদের পরিবারের লোকজন আরও বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল। বাড়িতে আসায় পরিবারের লোকজন এখন দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছে। কোরবানির ঈদের পর আবার জাহাজে যাব।’
তৌফিকুল বলেন, রমজান ছিল, তাই জলদস্যুরা শারীরিক নির্যাতন করেনি। তবে মাঝেমাঝে দুর্ব্যবহার করত এবং ভয় দেখাত। তখন মানসিক অবস্থা খারাপ ছিল, কী হবে বুঝতে পারছিলেন না। ফিরে আসতে পারবেন কিনা তাও জানতেন না। সেই দিনগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ। জলদস্যুরা নামাজ পড়া ও রোজা রাখতে বাধা দেয়নি। জাহাজের ক্যাপ্টেন বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।
তৌফিক বলেন, ২০০৮ সাল থেকে জাহাজে চাকরি করেন। অনেকবার এই রুটে যাওয়া-আসা করেছেন। কিন্তু আগে এখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি।
তৌফিকের স্ত্রী জোবাইদা নোমান বলেন, বিষাদময় দিনগুলো চলে গেছে, ওগুলো আর মনেও করতে চান না। আল্লাহর কাছে তাঁর একটাই চাওয়া, এ রকম দিন আর কারও জীবনে না আসুক। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী গরুর মাংসের কালো ভুনা ও পুডিং খেতে পছন্দ করে, এর পাশাপাশি তাঁর পছন্দের অন্যান্য খাবার রান্না করেছি।’
তৌফিকের মা দিল আফরোজ বলেন, ‘বুকের ধন ফিরে এসেছে, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।’
তৌফিকের শ্যালক শিব্বিন আহমেদ বলেন, বাবাকে জিম্মি করার খবর শোনার পর থেকে তাঁর (তৌফিক) ছেলে-মেয়ে মনমরা হয়ে থাকত। বাবা ফিরে আসায় বাচ্চারা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
তৌফিক বাড়ি থেকে গত ২৫ নভেম্বর জাহাজে গিয়েছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে।
বুধবার সকাল ৬টা ১০ মিনিট। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ছকড়িকান্দি গ্রামের নিজ বাড়িতে বড় ভাই হাসানের সঙ্গে এসে পৌঁছান তারেকুল ইসলাম। বাড়িতে প্রবেশের পর সবার মুখেই হাসি।
বাবা দেলোয়ার হোসেন ও মা হাসিনা বেগম বুকে জড়িয়ে নিলেন তারেকুলকে। সবার চোখেই আনন্দ অশ্রু। তারেকুল দেড় বছর বয়সী একমাত্র কন্যা তানজিহাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করছেন। স্ত্রী নুসরাত জাহান যূথীর চোখে মুখে হাসি। স্বামীকে দেখতে পেয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। বাবার কোল থেকে নামছেই না তানজিহা।
তারেকুলের স্ত্রী নুসরাত আগে থেকেই কেক এনে রেখেছেন। সবাই মিলে কেক কাটলেন, একে অপরকে খাইয়ে দিলেন। রান্না করা হচ্ছে তারেকুলের পছন্দের চিতই পিঠা ও মাংস। এ ছাড়া গরুর মাংস, শোল মাছসহ নানা পদের রান্না চলছে।
তারেকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমরা তো এবার ঈদ করতে পারি নাই। আগেই বলেছিলাম, ছেলে যেদিন বাড়িতে আসবে, সেই দিনই আমাদের ঈদ। আজ আমাদের ঈদ।’ তিনি আরও বলেন, ছেলেকে কাছে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে, তা বোঝাতে পারব না। নামাজ পড়েছেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন। ছেলের পছন্দের বিভিন্ন খাবার রান্না করছেন। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা আসছেন। সবাই খুব খুশি।
তারেকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ছেলে সুস্থভাবে বাড়িতে আসায় এমন খুশি হয়েছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না।
তারেকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন অনেক ভালো লাগছে। ভেবেছিলাম হয়তো আর কোনোদিন কারও সঙ্গে দেখা হবে না। আল্লাহর রহমতে বাবা-মায়ের দোয়ায় সুস্থভাবে ফিরে এসেছি। আমাদের উদ্ধারে যারা এগিয়ে এসেছেন, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
তারেকুলের স্ত্রী নুসরাত জাহান যূথী বলেন, ‘অনেক খুশি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তারেকুলের জন্য বিশেষ আয়োজন রয়েছে। আজকের দিনটি আমাদের ঈদের দিন।’
মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর গ্রামের নিজ বাড়িতে পৌঁছান সাজ্জাদ। তাঁকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন স্বজনরা। অনেকের চোখেই তখন আনন্দাশ্রু। সাজ্জাদকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
সাজ্জাদ হোসেনকে ফিরে পেয়ে মা শামসাদ বেগম বারবার চুমু খেতে থাকেন ছেলের মুখে। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন অঝোরে, আর বলতে থাকেন, ‘আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি বাবা।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা শামসাদ বেগম জানান, ছেলে জিম্মি থাকার মুহূর্তে তাদের পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। চরম দুশ্চিন্তায় দিন কেটেছিল তাদের। এখন ছেলেকে কাছে পেয়েছেন, এর চেয়ে আর বড় সুখ কী হতে পারে। ছেলে ফিরে আসায় আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া জানান তিনি।
সাজ্জাদের মা আরও বলেন, ছেলের পছন্দের খাবার বিরিয়ানি ও পদ্মা মাছ। ছেলে ঘরে ফিরবে, তাই এই খাবারগুলোর আয়োজন করেছেন। ছেলেকে কাছে পেয়ে ঈদের আনন্দ অনুভব হচ্ছে তাঁর। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ি ফেরেন একই ইউনিয়নের শামসুদ্দিন শিমুল। এ সময় বাবাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে শিমুলের তিন মেয়ে। বাবা ও মেয়েদের চোখ ভিজে যায় আনন্দে। শিমুলের স্ত্রী ফারজানা সুলতানা জানান, মেয়েদের নিয়ে দীর্ঘ একটা সময় দুশ্চিন্তায়পার করেছেন। মেয়েরা তখন বারবার জিজ্ঞেস করত, তাদের বাবা কখন ফিরে আসবে। আজ তিনি ফিরে এসেছেন। এই মুহূর্তটা তাদের কাছে খুবই আনন্দের।
শামসুদ্দিন শিমুল বলেন, ‘সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদশায় বিভীষিকাময় সময় পার করেছি সবাই। আমাদের সবসময় অস্ত্রের মুখে রাখে জলদস্যুরা। পরিবারের কাছে ফেরাটাই স্বপ্ন ছিল। এত দ্রুত কোনো জাহাজ জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায়নি। আমাদের কোম্পানি আন্তরিক ছিল বলেই আমরা বাড়িতে আসতে পেরেছি। আমাদের কোম্পানির সবাইকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
গত ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। ৩২ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তিপণ নিয়ে ১৪ এপ্রিল জাহাজটি ছেড়ে দেয় তারা। গত শনিবার জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে।
প্রকাশক ও সম্পাদক: নিত্যানন্দ সরকার
বার্তা ও বাণ্যিজিক কার্যালয় : শহীদ রীমু সরণি (বিটিসিএল মাইক্রোওয়েভ স্টেশেনের সামনে), সাতক্ষীরা।
ফোনঃ ০৪৭১-৬৪৭৬৭, ০১৭৪৮-৬৭০০৬৯
Email : sakalctc.bd@gmail.com
Copyright © 2024 PCBARTA. All rights reserved.