সাতক্ষীরা ১২:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ‘টার্গেটেড কিলিং’–এর প্রতিবাদে দৃকের সংহতি প্রকাশ এডভোকেট জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার ঘটনায় বাসদের নিন্দা ৭ মার্চসহ আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করে আদেশ জারি দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংগ্রাম শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত আটক সাবেক হেভিওয়েট মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে আদালত চত্বরে জুতা-ডিম নিক্ষেপ ওয়ার্কার্স পার্টির মেনন ৬ দিন ও জাসদের ইনুর ৭ দিন রিমান্ড মঞ্জুর আইসিটি’র ফেসবুক-ইউটিউব বন্ধ, পাসওয়ার্ড জানেন শুধু পলক আর.জি.কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক হত্যাকাণ্ড! বিক্ষোভে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ!

দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংগ্রাম

পিসিবার্তা ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ৬৯ বার পঠিত

দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংগ্রাম ও জীবনান্বেষণ : বাংলা কথা সাহিত্যে তার প্রভাব 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি


ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভূমি দ্বিখন্ডিত হয়। মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো পাকিস্তান পক্ষে এবং হিন্দু প্রধান প্রদেশ সমূহ ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে থাকল। ৱ্যাডক্লিপ খুব সহজেই ভারতীয় মানচিত্রকে আড়াআড়ি ভাগ করে দিলেও বিষয়টি মোটেও সহজতর ছিল না। অখন্ড ভারতভূমির প্রায় সব বর্ণ ও ধর্মের গণমানব এই অমানবিক দেশভাগের জন্য এক বিরাট কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তবে, সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন অখন্ড পাঞ্জাব এবং অখন্ড বাংলাদেশের অধিবাসীগণ। ভারত পাকিস্তানের নেতাদের নেহাতই অবিবেচক ও অমানবিক সিদ্ধান্ত ছিল এই দেশভাগ। এই একটি মাত্র সিদ্ধান্তই লক্ষ লক্ষ মানুষকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল। নিমিষেই জননী জন্মভূমি স্বদেশ আর মাতৃভূমি রইল না। উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়ে নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।

এই দেশ ত্যাগ মোটেও সহজ ছিল না। ভিটে মাটি ছেড়ে পুরোপুরি ভাবে চলে যাওয়ার যন্ত্রনা অবর্ণনীয়। আর এ যাত্রা তো আনন্দের নয়, ভয়ঙ্কর কষ্টের। মানুষ ছিন্নমূল হয়ে এল। উদ্বাস্তু বিষয়ে একটি উদ্ধৃতি সংযুক্ত করি, বিষয়টি ঋজু হবে।

“সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার ভূখন্ডে ঢুকল ওরা চোরের মত। ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষ পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটার মায়া কাটিয়ে ছুটেছিল এপার বাংলায়। সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা, পৈশাচিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আর সামনে ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যে মাটি ছিল মায়ের মতো, যার ফসলে ওদের জন্মগত অধিকার, সেখানে ওরা পরবাসী। এপারে ঝোপেঝাড়ে বিলে, অনাবাদি ভূখন্ডে গড়ে উঠল বসতি। যে সব জমি আগাছা ভরা, পরিত্যাক্ত, যেখানে, যেখানে কোনদিন ভুল করেও যায়নি মানুষ, বর্ষা ডেকে আনে প্রাণঘাতী বন্যা, সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বসতি। সরকারি অনুদানের ছিঁটেফোটা জুটল কপালে। কিন্তু বেঁচে থাকতে, মাটির ওপর শক্ত দুপায়ে দাঁড়াতে তার ভূমিকা ছিল নগন্য। যারা এল দান হাতে, ভাগ্য ফিরল তাদেরই, মানুষকে মানুষ কিভাবে বঞ্চিত করে, না খাইয়ে হাত পা বেঁধে ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তার ইতিহাস রক্তরঞ্জিত না হলেও মর্মান্তিক। একটি জাতিকে নিষ্ঠুরভাবে মুঝে ফেলার ষড়যন্ত্র যে কত নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল তার প্রমাণ সেদিনের অন্ধকারময় ইতিহাস। বাঙালিকে সেদিন ছিঁড়ে খেয়েছে বাঙালি – অবাঙালি। তাদের পরিণত করা হল একটি জড় পিন্ডে! অক্ষম, অপদার্থ, অলস এক জেনারেশন! যাদের কোনও ভূমিকা নেই! মানুষের যাবতীয় সদগুণকে পিষে মারা হল। ওদের পরিচয় হল উদ্বাস্তু”।

স্বাধীনতা উত্তর দাঙ্গা, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা বিচ্ছিন্ন কোন সংযোগ নয়। বরং একটির সাথে অপরটি গভীরভাবে সংযুক্ত। অবাঞ্চিত দেশভাগ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ স্বরূপ প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছিল। একটা উপেক্ষা, অনাহার ও অনাদার তাঁদের জীবনের অঙ্গস্বরূপ হয়ে উঠল। যেন মানুষ নয়, এমন ব্যবহার। পাঞ্জাব থেকে যাওয়া আসা উদ্বাস্তুদের সেই অর্থে বিরাট সমস্যা না হলেও পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা রিফিউজি, তাঁদের জীবনে এই দেশভাগ এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনল।

দেশভাগের সময় যে সকল উদ্বাস্তু জনমানব এসেছিলেন, তাঁরা ভারতভূমির বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল। সেই পরিসংখ্যান দেখলে, পশ্চিমবঙ্গের থেকেও বেশি উদ্বাস্তু মানব পাঞ্জাবে ভিড় জমিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু মানবের সংখ্যা ছিল ২০,৯৯,০৭১ জন, অন্যদিকে পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু জনমানব ছিল ৩২,৩১,৯৮১ জন। তবে, পাঞ্জাবের থেকে উদ্বাস্তু সমস্যায় বেশি জর্জরিত ছিল বাংলা প্রদেশ। কয়েকটি কারণ ছিল, প্রথমত পাঞ্জাবের তুলনায় বাংলাভূমি ছিল অনেক ছোট। দ্বিতীয়ত, বিনিময়ের ফলে পাঞ্জাব থেকে যত গণমানব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক কম সংখ্যক মানুষ পাঞ্জাবে এসেছিলেন। ফলে, পাকিস্তানে যাওয়া মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া সম্পত্তি, বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাভূমির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটেছিল ভিন্ন। বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুগণ ত্রিপুরা ও আসামের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বেশি আশ্রয় নেন। এই বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি।

পূর্ববঙ্গ থেকে কতজন উদ্বাস্তু এপার বাংলাতে এসেছিলেন সে বিষয় সম্পর্কে সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে একটা পরিসংখ্যান দিই, ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলাতে এসেছিলেন, ২১০৪২৪১ জন। ১৯৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল,৩০৬৮৭৫০ জন। ১৯৭১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে ছিল ৪২৯৩০০০ জন। ফলে, এই বিরাট জনসংখ্যার মানুষ এক প্রকার নিঃস্ব ভাবেই, ভিটামাটি ছেড়ে এপার বাংলাতে এসেছিলেন, উক্তহেতুগত কারণে বাংলাভূমি এক বিরাট উদ্বাস্তু সমস্যার মুখোমুখি হল।

আগত উদ্বাস্তু জনগনের একটা বিরাট অংশ ছিল ছিন্নমূল, বিষয়টি পূর্বেও বলেছি। যাইহোক, এই ভূমিহীন, জনমজুর সাধারণ মানুষ গুলোর স্থান হল প্লাটফর্ম, ভাঙা মন্দির, মিলিটারিদের পরিত্যাক্ত ছাউনি এবং মানুষের বাসের অযোগ্য সব ভূমিতে। এঁদের দখলে চলে গেল রেলের জমি, শহুরে ফুটপাত। গড়ে উঠল হাজার কলোনী।

দেশভাগ ও দাঙ্গায় পীড়িত জনমানবগণ যাঁরা দেশ ও ভিটামাটি ছেড়ে এসেছিলেন, তাঁরা পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আসা উদ্বাস্তুদের মত সাহায্য সহযোগিতা পেলেন না। পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা উদ্বাস্তু তাঁরা সাহায্য না পেলেও ঘৃণা ও প্রতারণা পেলেন ভাল মতই । ক্যাম্পগুলিতে ইতরের মত জীবন কাটল তাঁদের। কিন্তু তারপর উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষগুলো প্রবলভাবে ছিলেন শিকড়ের সন্ধানে এদেশের মাটিতে, এদেশের জনসমাজে। উদ্বাস্তু মানবকুল অবশেষে বিরাট সংগ্রাম করেই মিশে গেলেন এদেশের মাটি ও সভ্যতার গভীরে। গড়ে উঠল একাধিক কলোনী। একটা তথ্য দিই, গড়ে ওঠা কলোনী সমূহের ভিতর সরকারি সহযোগিতাই গড়ে ওঠা কলোনীর পরিমান ছিল শতকরাই ২৩.৩৮ শতাংশ। বাকি ৭৬.৬২ শতাংশ কলোনী উদ্বাস্তু জনমানবগণ নিজেদের উদ্যোগেই গড়ে তুলেছিলেন। আসলে, উদ্বাস্তু জনসাধারণের জীবনী শক্তি ছিল ঈর্ষা করবার মত। সরকারি প্রতিরোধ, স্থানীয় মানুষের অসহযোগিতা ও উপেক্ষা এবং আরও লক্ষ প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এই মানুষগুলো থেমে থাকলেন না । মোদ্দা কথা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই মানুষগুলো এক প্রবল ও বিরাট লড়াইয়ের মধ্যেই এদেশে পেলেন মাথা গুঁজবার এক চিলতে আকাশ।

দেশভাগের ভয়াবহতা, সাধারণ ভিটামাটি ছাড়া জনমানুষের কথা প্রথম দিকের সাহিত্যে তেমন ভাবে উঠে আসেনি। মানিক, তারাশঙ্করের মত প্রণাম্য সাহিত্য সাধকদেরও রেলের জমি দখল করে বসা কিম্বা শহুরে ফুটপাতে সংসার যাপন করা মানুষগুলোর বিরাট কষ্ট সেই অর্থে স্পর্শ করতে পারেনি। তবে, যেহেতু ভারতীয় জীবনে দেশভাগ এক বিরাট অভিশাপের মত, উক্তহেতুগত কারণে দেশভাগের যন্ত্রনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সাহিত্য সাধকদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ফলে, পরবর্তীতে দেশভাগের পীড়া ও আর্তনাদ বাংলাভূমির কবি, নাট্যকার ও কথাকারদের মানসপটকে আলোড়িত করেছে। গল্পকারেরা লিখেছেন সহস্র সব ছোট গল্প। দেরিতে হলেও দেশভাগের পটভূমির উপর গড়ে উঠল একাধিক স্বরণীয় সব উপন্যাস। অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদ বৃক্ষ’, জ্যোতিরিন্দ নন্দির ‘বারো ঘর এক উঠান’ প্রভৃতি দেশভাগ প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা উপন্যাস।

সাহিত্য সমাজের দর্পন, বিষয়টি চিরকালীন ভাবেই সত্য। ফলে, এত বড় একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রেয় বিপর্যয়কে এড়িয়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কবি মঙ্গলাচরণ তাঁর কবিতার মধ্যে ব্যাপকভাবে আনলেন এই প্রান্তিক ভূমিহীন মানুষগুলোর কথকতা। একটি কবিতায় মঙ্গলাচরণ লিখছেন,

‘এস দেখে যাও কুটিকুটি সংসার।
স্টেশনের প্লাটফর্ম ছড়ানো বে – আব্রু সংসারে
স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে
ভেসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও – যে
ছেঁড়া কানিটুকু,কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ –
আমার বাংলা।’

আবার একত্রে তিনি লিখলেন,

‘রোজই রাস্তায় দেখি ফুটপাতের হাঁড়িকুড়ি – ছড়ানো সংসারে / শুকনো মুখ, উস্কোখুস্ক চুল /
শিয়ালদ’র প্লাটফর্মে আছড়ে পড়া উদ্বাস্তু সংসারে / বিষাদ প্রতিমা’

বিষ্ণু দের কবিতাতেও দেশভাগের ফলে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর জীবনপট ধরা পড়ে। কবি লিখলেন,

‘এখানে ওখানে দেখো দেশছাড়া লোকের ছায়ায় হাঁপায় / পার্কের ধারে শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায় / ভাবে ওরা কী যে ভাবে! ছেড়ে খোঁজে দেশ / এইখানে কেউ বরিশালের কেউ – বা ঢাকায়।’

সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’ নাটকটি দেশভাগের অশ্রু ও কান্নার এক গভীর চিত্রপট। এখানে উল্লেখ করি, প্রথম দিকে বাংলা কথাসাহিত্য দেশভাগ বিষয়ে কিছুটা চুপ থাকলেও পরবর্তীতে দেশভাগের উপরে কথাসাহিত্যে খুব ভাল রকম কাজ হয়েছে। প্রথম দিকের চুপ প্রবাহের পর পঞ্চাশের দশকে উঠে আসা কথাকারদের কলমে জীবন্ত হয়ে উঠল দেশভাগের যন্ত্রণাকর তিক্ততার কথা ।ছিন্নমূল মানুষের বিপর্যয় ও যন্ত্রণাকর ছবিপট চিত্রিত হল, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নির্বাস’ (১৯৬০) উপন্যাসে, নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’ (১৯৫৫), ‘বাল্মীক’ (১৯৫৮), ‘অরণ্যদন্ডক’ (১৯৬১), শক্তিপদ রাজগুরুর ‘তবু বিহঙ্গ’ (১৯৬০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়র ‘অর্জুন’ (১৯৭১), সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’ (১৯৬৯), নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘দূরভাষীনি’ (১৯৫২), অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ (১৯৭৮), ‘আবাদ’ (১৯৮৭), ‘মৃন্ময়ী’ (১৯৮৭), ‘দেবমহিমা’ (১৯৮৪) প্রভৃতি উপন্যাসে। এছাড়াও একাধিক গল্প উপন্যাসে গভীরভাবেই এসেছে দেশভাগের হৃদয়বিদারক ঘটনাপ্রবাহ সব ছবিপট।

অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নির্বাস’ উপন্যাসখানি দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন রেলের পড়ে থাকা পতিত জমি ও প্লাটফর্মগুলিতে। এক অসহায় জীবনছবি। নির্বাস উপন্যাসে অমিয়ভূষণ এই প্লাটফর্মবাসী গণমানবের জীবন সংগ্রামকেই তাঁর উপন্যাসের বিষয় হিসাবে গ্রহণ করলেন। আবার, এই ধারার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন সাবিত্রী রায়ের ‘স্বরলিপি’। উক্ত উপন্যাসে বরিশাল এক্সপ্রেসে আসা হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের জীবনপ্রবাহের গল্প চিত্রিত হয়েছে। প্রফুল্ল রায়ের ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি স্বরণযোগ্য উপন্যাস। এই উপন্যাসে শ্রী রায় প্লাটফর্মবাসী মানুষের বেআব্রু জীবনযাপনের হৃদয়বিদারক ছবিপট দক্ষতার সাথে অঙ্কন করেছেন। নারায়ণ সান্যাল দেশভাগের প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘বাল্মীক’ ও ‘বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’। ‘বাল্মীক’ উপন্যাসে লক্ষ্যগোচর হয় হাজার হাজার উদ্বাস্তু গণমানুষের সমস্যার কথা । আবার, ‘ বকুলতলা পি.এল ক্যাম্প ‘ উপন্যাসে ক্যাম্পবাসী মানুষের ইতরময় জীবন ও যাতনার কথা গভীর উদ্বেগের সাথে চিত্রিত হয়েছে ।তবে এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন, তা হল, দেশভাগের আর্তনাদ ও কষ্টের ছবিপট কথাসাহিত্যে লিখিত হলেও, ছিন্নমূল এই মানুষগুলো কিভাবে এদেশের মাটিতে জায়গা করে নিল, সেই পরিআবহের বিষয়ে তেমনভাবে আলোকপাত করেননি কথাকারগণ ।বিশিষ্ট একজন গবেষক কিছুটা আক্ষেপ করেই লিখেছিলেন,

‘এই উদ্বাস্তু কলোনী গড়ে তোলার, এই ছিন্নমূল মানুষের নতুন দেশের মাটিতে শিকড় চারিয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম তার প্রায় কোন চিহ্ন বাংলা সাহিত্যে নেই । বাঙালির এই যে প্রচন্ড প্রাণশক্তির পরিচয় আমরা রাতারাতি উদ্বাস্তু উপনিবেশ গড়ে তোলায় পাই, গুন্ডা পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে পাই, চলল মেয়ে রণে চলল মেয়েদের রণরঙ্গিনী মূর্তিতে পাই, কলকাতার পথে পথে মিছিলে পাই, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পাই – তার কথা বাংলা সাহিত্য বলল না, আমাদের সাহিত্য বোবা হয়ে থাকল’

তবে, এ বিষয়ে আমরা অতীন বন্দোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করব। তিনি বেশ ব্যতিক্রম। তাঁর সাহিত্য কথায় পাই উদ্বাস্তু মানুষের সংগ্রাম, এদেশের সমাজ ও মাটিতে শিকড় ছড়ানোর ইতিবৃত্তের সব গল্প। আমরা অনেকেই জানি, দেশবিভাগের অপঘাত খুব কাছ থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কেননা তিনি নিজেই ছিলেন দেশভাগের শিকার। এই অপত্যাশিত অভিশাপ যখন তিনটি দেশের মানুষের জীবনকে ‘ঘেঁটে ঘ’ করে দিয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। পরিবারের অন্যদের সাথে তিনিও এসেছিলেন ছিন্নমূল হয়ে। ফলে তাঁর লেখাতে দেশভাগ ও দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সংগ্রাম এবং শিকড় সন্ধ্যানের ছবিপট বিশ্বস্ততার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’ প্রভৃতি উপন্যাসে দেশভাগের গভীর ছায়া লক্ষ্যগোচর হয়। আসলে ছিন্নমূল জীবনকে নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন বলেই তাঁর উপন্যাসের চরিত্র ও ছবিপট এতটা জীবন্ত। তিনি লিখছেন,

‘যেন জীবন শেষ হয়েও হয় না । যা লিখি, মনে হয় তারপরও লেখা বাকি থেকে যায়, সেই কবে বাবা কাকা জ্যাঠার সঙ্গে’ বঙ্গ আমার জননী আমার ‘ কথা ভুলে এ দেশে পদার্পণ। ছিন্নমূল জীবনে দেখেছিলাম একখন্ড জমি, একটুখানি বাড়ি, একটুখানি আশ্রয়, একটুখানি আহারের জন্য জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বের পড়েছেন। যাঁরা অতীতে ছিলেন, এখনও যাঁরা আছেন – দুর্গম কঠিন সংগ্রামের ভেতড় থিতু হয়েছিলেন বা হয়েছেন, মহাকাল তাঁদের সেই সংগ্রামের ইতিহাস গ্রাস করবেই যতটুকু পারা যায় দর্পণে উদ্ভাসিত করে রাখা।’

অতীন বন্দোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য জীবন জুড়ে এই মহৎ কাজটি সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথাকার হাসান আজিজুল হক। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লিখিত তাঁর একটি অনবদ্য সাহিত্যকাজ ‘আগুন পাখি’ নাম উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পপট ভীষণ চমৎকার এবং হৃদয়বিদারক। গ্রাম্য এক বধূ। যাঁর শ্বশুরবাড়ি এবং বাবার বাড়ির যে মানুষগুলো তাঁর পরম আপন ও কাছের, তাঁরা বেশিরভাগই হিন্দুজন। গভীর মমতায় বাঁধা তাঁদের জীবনপ্রবাহ। মেয়েটি স্বামীর কাছ থেকেই শিখে নেয় অল্প স্বল্প লেখাপড়াও। কালে কালে মেয়েটি হিন্দু মুসলমান সকলের কাছে শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভাঙন ধরে। একান্নবর্তী ভাবনা ফিকে ধরতে শুরু করল। বাইরে রব উঠল দেশটা নাকি ভাগ হবে। এক বিরাট হৃদয়পীড়ার মুখে পড়ল মানুষগুলো। আশঙ্কা একদিন সত্য হল। আড়াআড়ি ভাগ হল দেশ। মানুষও। মুসলমান পাড়ার গণমানুষরা চলে যেতে লাগলেন ভিটে ছেড়ে। অচেনা দেশে ।কিন্তু সেই মেয়েটি দেশভাগকে মানতে পারল না। এই দেশটা তাঁর নয়, এই ভাবনাটাই তাঁর কাছে গভীর পীড়ার।

‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলেনা ক্যানে আলাদা একটো দ্যাশ হয়েছে…..এই দ্যাশটা আমার লয়।’

দেশভাগের তিক্ততা ও আবেগঘন বিচ্ছেদ উপন্যাসটি অনবদ্য শৈল্পিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছে।

দেশভাগের উপর লিখিত অন্য একটি অনবদ্য উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’। দেশভাগ পীড়ার শিকার হয়েছিলেন সুনীল নিজেই। প্রখ্যাত লেখক হর্ষ দত্তের সাথে এক আলাপচারিতায়, ‘নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়েছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে?’ এই প্রশ্নর উত্তরে সুনীল বলেছিলেন,

‘দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সব সময় মনে পড়ে। ৪৭ এর ১৫ ই আগষ্টের সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হল, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।’

এই বেদনার স্বরলিপির রুপদান করেছেন সুনীল তাঁর ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ নামক উপন্যাসে। উদ্বাস্তু মানুষগুলোর অসহায় জীবন ও লড়াই করবার প্রতিস্পর্ধার এক অনন্য বিনির্মাণ। এছাড়াও দেশভাগের ছায়া মেলে যেসব সাহিত্য আকর সমূহে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন্ মিঞা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেড মাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, বেগম হাশমত রশিদের ‘ফরিয়াদ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’ ও ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুইকুল হারা’ প্রভৃতি কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে।

তথ্যসূত্র: ১) ছিন্নমূল রাজনীতির উৎস সন্ধানে: শিবাজী প্রতীম বসু। ২) বাংলায় গণ আন্দোলনের ছয় দশক: কমল চৌধুরী। ৩) ‘এস দেখে যাও’, কবিতা – মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ৪) ‘জল দাও’ -বিষ্ণু দে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ: দেবদুলাল মান্না


আরিফুল ইসলাম সাহাজি
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংগ্রাম

আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংগ্রাম ও জীবনান্বেষণ : বাংলা কথা সাহিত্যে তার প্রভাব 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি


ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভূমি দ্বিখন্ডিত হয়। মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো পাকিস্তান পক্ষে এবং হিন্দু প্রধান প্রদেশ সমূহ ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে থাকল। ৱ্যাডক্লিপ খুব সহজেই ভারতীয় মানচিত্রকে আড়াআড়ি ভাগ করে দিলেও বিষয়টি মোটেও সহজতর ছিল না। অখন্ড ভারতভূমির প্রায় সব বর্ণ ও ধর্মের গণমানব এই অমানবিক দেশভাগের জন্য এক বিরাট কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তবে, সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন অখন্ড পাঞ্জাব এবং অখন্ড বাংলাদেশের অধিবাসীগণ। ভারত পাকিস্তানের নেতাদের নেহাতই অবিবেচক ও অমানবিক সিদ্ধান্ত ছিল এই দেশভাগ। এই একটি মাত্র সিদ্ধান্তই লক্ষ লক্ষ মানুষকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল। নিমিষেই জননী জন্মভূমি স্বদেশ আর মাতৃভূমি রইল না। উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়ে নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।

এই দেশ ত্যাগ মোটেও সহজ ছিল না। ভিটে মাটি ছেড়ে পুরোপুরি ভাবে চলে যাওয়ার যন্ত্রনা অবর্ণনীয়। আর এ যাত্রা তো আনন্দের নয়, ভয়ঙ্কর কষ্টের। মানুষ ছিন্নমূল হয়ে এল। উদ্বাস্তু বিষয়ে একটি উদ্ধৃতি সংযুক্ত করি, বিষয়টি ঋজু হবে।

“সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার ভূখন্ডে ঢুকল ওরা চোরের মত। ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষ পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটার মায়া কাটিয়ে ছুটেছিল এপার বাংলায়। সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা, পৈশাচিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আর সামনে ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যে মাটি ছিল মায়ের মতো, যার ফসলে ওদের জন্মগত অধিকার, সেখানে ওরা পরবাসী। এপারে ঝোপেঝাড়ে বিলে, অনাবাদি ভূখন্ডে গড়ে উঠল বসতি। যে সব জমি আগাছা ভরা, পরিত্যাক্ত, যেখানে, যেখানে কোনদিন ভুল করেও যায়নি মানুষ, বর্ষা ডেকে আনে প্রাণঘাতী বন্যা, সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বসতি। সরকারি অনুদানের ছিঁটেফোটা জুটল কপালে। কিন্তু বেঁচে থাকতে, মাটির ওপর শক্ত দুপায়ে দাঁড়াতে তার ভূমিকা ছিল নগন্য। যারা এল দান হাতে, ভাগ্য ফিরল তাদেরই, মানুষকে মানুষ কিভাবে বঞ্চিত করে, না খাইয়ে হাত পা বেঁধে ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তার ইতিহাস রক্তরঞ্জিত না হলেও মর্মান্তিক। একটি জাতিকে নিষ্ঠুরভাবে মুঝে ফেলার ষড়যন্ত্র যে কত নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল তার প্রমাণ সেদিনের অন্ধকারময় ইতিহাস। বাঙালিকে সেদিন ছিঁড়ে খেয়েছে বাঙালি – অবাঙালি। তাদের পরিণত করা হল একটি জড় পিন্ডে! অক্ষম, অপদার্থ, অলস এক জেনারেশন! যাদের কোনও ভূমিকা নেই! মানুষের যাবতীয় সদগুণকে পিষে মারা হল। ওদের পরিচয় হল উদ্বাস্তু”।

স্বাধীনতা উত্তর দাঙ্গা, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা বিচ্ছিন্ন কোন সংযোগ নয়। বরং একটির সাথে অপরটি গভীরভাবে সংযুক্ত। অবাঞ্চিত দেশভাগ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ স্বরূপ প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছিল। একটা উপেক্ষা, অনাহার ও অনাদার তাঁদের জীবনের অঙ্গস্বরূপ হয়ে উঠল। যেন মানুষ নয়, এমন ব্যবহার। পাঞ্জাব থেকে যাওয়া আসা উদ্বাস্তুদের সেই অর্থে বিরাট সমস্যা না হলেও পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা রিফিউজি, তাঁদের জীবনে এই দেশভাগ এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনল।

দেশভাগের সময় যে সকল উদ্বাস্তু জনমানব এসেছিলেন, তাঁরা ভারতভূমির বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল। সেই পরিসংখ্যান দেখলে, পশ্চিমবঙ্গের থেকেও বেশি উদ্বাস্তু মানব পাঞ্জাবে ভিড় জমিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু মানবের সংখ্যা ছিল ২০,৯৯,০৭১ জন, অন্যদিকে পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু জনমানব ছিল ৩২,৩১,৯৮১ জন। তবে, পাঞ্জাবের থেকে উদ্বাস্তু সমস্যায় বেশি জর্জরিত ছিল বাংলা প্রদেশ। কয়েকটি কারণ ছিল, প্রথমত পাঞ্জাবের তুলনায় বাংলাভূমি ছিল অনেক ছোট। দ্বিতীয়ত, বিনিময়ের ফলে পাঞ্জাব থেকে যত গণমানব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক কম সংখ্যক মানুষ পাঞ্জাবে এসেছিলেন। ফলে, পাকিস্তানে যাওয়া মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া সম্পত্তি, বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাভূমির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটেছিল ভিন্ন। বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুগণ ত্রিপুরা ও আসামের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বেশি আশ্রয় নেন। এই বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি।

পূর্ববঙ্গ থেকে কতজন উদ্বাস্তু এপার বাংলাতে এসেছিলেন সে বিষয় সম্পর্কে সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে একটা পরিসংখ্যান দিই, ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলাতে এসেছিলেন, ২১০৪২৪১ জন। ১৯৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল,৩০৬৮৭৫০ জন। ১৯৭১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে ছিল ৪২৯৩০০০ জন। ফলে, এই বিরাট জনসংখ্যার মানুষ এক প্রকার নিঃস্ব ভাবেই, ভিটামাটি ছেড়ে এপার বাংলাতে এসেছিলেন, উক্তহেতুগত কারণে বাংলাভূমি এক বিরাট উদ্বাস্তু সমস্যার মুখোমুখি হল।

আগত উদ্বাস্তু জনগনের একটা বিরাট অংশ ছিল ছিন্নমূল, বিষয়টি পূর্বেও বলেছি। যাইহোক, এই ভূমিহীন, জনমজুর সাধারণ মানুষ গুলোর স্থান হল প্লাটফর্ম, ভাঙা মন্দির, মিলিটারিদের পরিত্যাক্ত ছাউনি এবং মানুষের বাসের অযোগ্য সব ভূমিতে। এঁদের দখলে চলে গেল রেলের জমি, শহুরে ফুটপাত। গড়ে উঠল হাজার কলোনী।

দেশভাগ ও দাঙ্গায় পীড়িত জনমানবগণ যাঁরা দেশ ও ভিটামাটি ছেড়ে এসেছিলেন, তাঁরা পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আসা উদ্বাস্তুদের মত সাহায্য সহযোগিতা পেলেন না। পশ্চিমবঙ্গের যাঁরা উদ্বাস্তু তাঁরা সাহায্য না পেলেও ঘৃণা ও প্রতারণা পেলেন ভাল মতই । ক্যাম্পগুলিতে ইতরের মত জীবন কাটল তাঁদের। কিন্তু তারপর উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষগুলো প্রবলভাবে ছিলেন শিকড়ের সন্ধানে এদেশের মাটিতে, এদেশের জনসমাজে। উদ্বাস্তু মানবকুল অবশেষে বিরাট সংগ্রাম করেই মিশে গেলেন এদেশের মাটি ও সভ্যতার গভীরে। গড়ে উঠল একাধিক কলোনী। একটা তথ্য দিই, গড়ে ওঠা কলোনী সমূহের ভিতর সরকারি সহযোগিতাই গড়ে ওঠা কলোনীর পরিমান ছিল শতকরাই ২৩.৩৮ শতাংশ। বাকি ৭৬.৬২ শতাংশ কলোনী উদ্বাস্তু জনমানবগণ নিজেদের উদ্যোগেই গড়ে তুলেছিলেন। আসলে, উদ্বাস্তু জনসাধারণের জীবনী শক্তি ছিল ঈর্ষা করবার মত। সরকারি প্রতিরোধ, স্থানীয় মানুষের অসহযোগিতা ও উপেক্ষা এবং আরও লক্ষ প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এই মানুষগুলো থেমে থাকলেন না । মোদ্দা কথা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই মানুষগুলো এক প্রবল ও বিরাট লড়াইয়ের মধ্যেই এদেশে পেলেন মাথা গুঁজবার এক চিলতে আকাশ।

দেশভাগের ভয়াবহতা, সাধারণ ভিটামাটি ছাড়া জনমানুষের কথা প্রথম দিকের সাহিত্যে তেমন ভাবে উঠে আসেনি। মানিক, তারাশঙ্করের মত প্রণাম্য সাহিত্য সাধকদেরও রেলের জমি দখল করে বসা কিম্বা শহুরে ফুটপাতে সংসার যাপন করা মানুষগুলোর বিরাট কষ্ট সেই অর্থে স্পর্শ করতে পারেনি। তবে, যেহেতু ভারতীয় জীবনে দেশভাগ এক বিরাট অভিশাপের মত, উক্তহেতুগত কারণে দেশভাগের যন্ত্রনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সাহিত্য সাধকদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ফলে, পরবর্তীতে দেশভাগের পীড়া ও আর্তনাদ বাংলাভূমির কবি, নাট্যকার ও কথাকারদের মানসপটকে আলোড়িত করেছে। গল্পকারেরা লিখেছেন সহস্র সব ছোট গল্প। দেরিতে হলেও দেশভাগের পটভূমির উপর গড়ে উঠল একাধিক স্বরণীয় সব উপন্যাস। অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদ বৃক্ষ’, জ্যোতিরিন্দ নন্দির ‘বারো ঘর এক উঠান’ প্রভৃতি দেশভাগ প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা উপন্যাস।

সাহিত্য সমাজের দর্পন, বিষয়টি চিরকালীন ভাবেই সত্য। ফলে, এত বড় একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রেয় বিপর্যয়কে এড়িয়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কবি মঙ্গলাচরণ তাঁর কবিতার মধ্যে ব্যাপকভাবে আনলেন এই প্রান্তিক ভূমিহীন মানুষগুলোর কথকতা। একটি কবিতায় মঙ্গলাচরণ লিখছেন,

‘এস দেখে যাও কুটিকুটি সংসার।
স্টেশনের প্লাটফর্ম ছড়ানো বে – আব্রু সংসারে
স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে
ভেসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও – যে
ছেঁড়া কানিটুকু,কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ –
আমার বাংলা।’

আবার একত্রে তিনি লিখলেন,

‘রোজই রাস্তায় দেখি ফুটপাতের হাঁড়িকুড়ি – ছড়ানো সংসারে / শুকনো মুখ, উস্কোখুস্ক চুল /
শিয়ালদ’র প্লাটফর্মে আছড়ে পড়া উদ্বাস্তু সংসারে / বিষাদ প্রতিমা’

বিষ্ণু দের কবিতাতেও দেশভাগের ফলে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর জীবনপট ধরা পড়ে। কবি লিখলেন,

‘এখানে ওখানে দেখো দেশছাড়া লোকের ছায়ায় হাঁপায় / পার্কের ধারে শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায় / ভাবে ওরা কী যে ভাবে! ছেড়ে খোঁজে দেশ / এইখানে কেউ বরিশালের কেউ – বা ঢাকায়।’

সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’ নাটকটি দেশভাগের অশ্রু ও কান্নার এক গভীর চিত্রপট। এখানে উল্লেখ করি, প্রথম দিকে বাংলা কথাসাহিত্য দেশভাগ বিষয়ে কিছুটা চুপ থাকলেও পরবর্তীতে দেশভাগের উপরে কথাসাহিত্যে খুব ভাল রকম কাজ হয়েছে। প্রথম দিকের চুপ প্রবাহের পর পঞ্চাশের দশকে উঠে আসা কথাকারদের কলমে জীবন্ত হয়ে উঠল দেশভাগের যন্ত্রণাকর তিক্ততার কথা ।ছিন্নমূল মানুষের বিপর্যয় ও যন্ত্রণাকর ছবিপট চিত্রিত হল, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নির্বাস’ (১৯৬০) উপন্যাসে, নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’ (১৯৫৫), ‘বাল্মীক’ (১৯৫৮), ‘অরণ্যদন্ডক’ (১৯৬১), শক্তিপদ রাজগুরুর ‘তবু বিহঙ্গ’ (১৯৬০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়র ‘অর্জুন’ (১৯৭১), সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’ (১৯৬৯), নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘দূরভাষীনি’ (১৯৫২), অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ (১৯৭৮), ‘আবাদ’ (১৯৮৭), ‘মৃন্ময়ী’ (১৯৮৭), ‘দেবমহিমা’ (১৯৮৪) প্রভৃতি উপন্যাসে। এছাড়াও একাধিক গল্প উপন্যাসে গভীরভাবেই এসেছে দেশভাগের হৃদয়বিদারক ঘটনাপ্রবাহ সব ছবিপট।

অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘নির্বাস’ উপন্যাসখানি দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন রেলের পড়ে থাকা পতিত জমি ও প্লাটফর্মগুলিতে। এক অসহায় জীবনছবি। নির্বাস উপন্যাসে অমিয়ভূষণ এই প্লাটফর্মবাসী গণমানবের জীবন সংগ্রামকেই তাঁর উপন্যাসের বিষয় হিসাবে গ্রহণ করলেন। আবার, এই ধারার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন সাবিত্রী রায়ের ‘স্বরলিপি’। উক্ত উপন্যাসে বরিশাল এক্সপ্রেসে আসা হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের জীবনপ্রবাহের গল্প চিত্রিত হয়েছে। প্রফুল্ল রায়ের ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি স্বরণযোগ্য উপন্যাস। এই উপন্যাসে শ্রী রায় প্লাটফর্মবাসী মানুষের বেআব্রু জীবনযাপনের হৃদয়বিদারক ছবিপট দক্ষতার সাথে অঙ্কন করেছেন। নারায়ণ সান্যাল দেশভাগের প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘বাল্মীক’ ও ‘বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’। ‘বাল্মীক’ উপন্যাসে লক্ষ্যগোচর হয় হাজার হাজার উদ্বাস্তু গণমানুষের সমস্যার কথা । আবার, ‘ বকুলতলা পি.এল ক্যাম্প ‘ উপন্যাসে ক্যাম্পবাসী মানুষের ইতরময় জীবন ও যাতনার কথা গভীর উদ্বেগের সাথে চিত্রিত হয়েছে ।তবে এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন, তা হল, দেশভাগের আর্তনাদ ও কষ্টের ছবিপট কথাসাহিত্যে লিখিত হলেও, ছিন্নমূল এই মানুষগুলো কিভাবে এদেশের মাটিতে জায়গা করে নিল, সেই পরিআবহের বিষয়ে তেমনভাবে আলোকপাত করেননি কথাকারগণ ।বিশিষ্ট একজন গবেষক কিছুটা আক্ষেপ করেই লিখেছিলেন,

‘এই উদ্বাস্তু কলোনী গড়ে তোলার, এই ছিন্নমূল মানুষের নতুন দেশের মাটিতে শিকড় চারিয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম তার প্রায় কোন চিহ্ন বাংলা সাহিত্যে নেই । বাঙালির এই যে প্রচন্ড প্রাণশক্তির পরিচয় আমরা রাতারাতি উদ্বাস্তু উপনিবেশ গড়ে তোলায় পাই, গুন্ডা পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে পাই, চলল মেয়ে রণে চলল মেয়েদের রণরঙ্গিনী মূর্তিতে পাই, কলকাতার পথে পথে মিছিলে পাই, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পাই – তার কথা বাংলা সাহিত্য বলল না, আমাদের সাহিত্য বোবা হয়ে থাকল’

তবে, এ বিষয়ে আমরা অতীন বন্দোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করব। তিনি বেশ ব্যতিক্রম। তাঁর সাহিত্য কথায় পাই উদ্বাস্তু মানুষের সংগ্রাম, এদেশের সমাজ ও মাটিতে শিকড় ছড়ানোর ইতিবৃত্তের সব গল্প। আমরা অনেকেই জানি, দেশবিভাগের অপঘাত খুব কাছ থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কেননা তিনি নিজেই ছিলেন দেশভাগের শিকার। এই অপত্যাশিত অভিশাপ যখন তিনটি দেশের মানুষের জীবনকে ‘ঘেঁটে ঘ’ করে দিয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। পরিবারের অন্যদের সাথে তিনিও এসেছিলেন ছিন্নমূল হয়ে। ফলে তাঁর লেখাতে দেশভাগ ও দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সংগ্রাম এবং শিকড় সন্ধ্যানের ছবিপট বিশ্বস্ততার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’ ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’ প্রভৃতি উপন্যাসে দেশভাগের গভীর ছায়া লক্ষ্যগোচর হয়। আসলে ছিন্নমূল জীবনকে নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন বলেই তাঁর উপন্যাসের চরিত্র ও ছবিপট এতটা জীবন্ত। তিনি লিখছেন,

‘যেন জীবন শেষ হয়েও হয় না । যা লিখি, মনে হয় তারপরও লেখা বাকি থেকে যায়, সেই কবে বাবা কাকা জ্যাঠার সঙ্গে’ বঙ্গ আমার জননী আমার ‘ কথা ভুলে এ দেশে পদার্পণ। ছিন্নমূল জীবনে দেখেছিলাম একখন্ড জমি, একটুখানি বাড়ি, একটুখানি আশ্রয়, একটুখানি আহারের জন্য জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বের পড়েছেন। যাঁরা অতীতে ছিলেন, এখনও যাঁরা আছেন – দুর্গম কঠিন সংগ্রামের ভেতড় থিতু হয়েছিলেন বা হয়েছেন, মহাকাল তাঁদের সেই সংগ্রামের ইতিহাস গ্রাস করবেই যতটুকু পারা যায় দর্পণে উদ্ভাসিত করে রাখা।’

অতীন বন্দোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য জীবন জুড়ে এই মহৎ কাজটি সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথাকার হাসান আজিজুল হক। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লিখিত তাঁর একটি অনবদ্য সাহিত্যকাজ ‘আগুন পাখি’ নাম উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পপট ভীষণ চমৎকার এবং হৃদয়বিদারক। গ্রাম্য এক বধূ। যাঁর শ্বশুরবাড়ি এবং বাবার বাড়ির যে মানুষগুলো তাঁর পরম আপন ও কাছের, তাঁরা বেশিরভাগই হিন্দুজন। গভীর মমতায় বাঁধা তাঁদের জীবনপ্রবাহ। মেয়েটি স্বামীর কাছ থেকেই শিখে নেয় অল্প স্বল্প লেখাপড়াও। কালে কালে মেয়েটি হিন্দু মুসলমান সকলের কাছে শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভাঙন ধরে। একান্নবর্তী ভাবনা ফিকে ধরতে শুরু করল। বাইরে রব উঠল দেশটা নাকি ভাগ হবে। এক বিরাট হৃদয়পীড়ার মুখে পড়ল মানুষগুলো। আশঙ্কা একদিন সত্য হল। আড়াআড়ি ভাগ হল দেশ। মানুষও। মুসলমান পাড়ার গণমানুষরা চলে যেতে লাগলেন ভিটে ছেড়ে। অচেনা দেশে ।কিন্তু সেই মেয়েটি দেশভাগকে মানতে পারল না। এই দেশটা তাঁর নয়, এই ভাবনাটাই তাঁর কাছে গভীর পীড়ার।

‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলেনা ক্যানে আলাদা একটো দ্যাশ হয়েছে…..এই দ্যাশটা আমার লয়।’

দেশভাগের তিক্ততা ও আবেগঘন বিচ্ছেদ উপন্যাসটি অনবদ্য শৈল্পিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছে।

দেশভাগের উপর লিখিত অন্য একটি অনবদ্য উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’। দেশভাগ পীড়ার শিকার হয়েছিলেন সুনীল নিজেই। প্রখ্যাত লেখক হর্ষ দত্তের সাথে এক আলাপচারিতায়, ‘নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়েছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে?’ এই প্রশ্নর উত্তরে সুনীল বলেছিলেন,

‘দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সব সময় মনে পড়ে। ৪৭ এর ১৫ ই আগষ্টের সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হল, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।’

এই বেদনার স্বরলিপির রুপদান করেছেন সুনীল তাঁর ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ নামক উপন্যাসে। উদ্বাস্তু মানুষগুলোর অসহায় জীবন ও লড়াই করবার প্রতিস্পর্ধার এক অনন্য বিনির্মাণ। এছাড়াও দেশভাগের ছায়া মেলে যেসব সাহিত্য আকর সমূহে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন্ মিঞা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেড মাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, বেগম হাশমত রশিদের ‘ফরিয়াদ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’ ও ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুইকুল হারা’ প্রভৃতি কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে।

তথ্যসূত্র: ১) ছিন্নমূল রাজনীতির উৎস সন্ধানে: শিবাজী প্রতীম বসু। ২) বাংলায় গণ আন্দোলনের ছয় দশক: কমল চৌধুরী। ৩) ‘এস দেখে যাও’, কবিতা – মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ৪) ‘জল দাও’ -বিষ্ণু দে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ: দেবদুলাল মান্না


আরিফুল ইসলাম সাহাজি
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ