
বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদগুলোর একটি হলো চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বেশির ভাগ পরিচালিত হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের ভাষ্য, ডিপি ওয়ার্ল্ড পৃথিবীর অনেক দেশের বন্দর পরিচালনার কাজ করছে; তারা আন্তর্জাতিক মানের বন্দর পরিচালনায় দক্ষ। ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো অভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে বন্দরের আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং বন্দরের কার্যকারিতা বাড়বে।
সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে কেউ কেউ বলছেন, সমুদ্রবন্দর ইজারা কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি একটি কৌশলগত বিষয়। এর ফলে জাতীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোনো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে।
এই চুক্তির আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলো পরিচালনা, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এবং প্রবেশাধিকারসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। এর ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে; ভবিষ্যতে এ সম্পদ ঘিরে জটিলতা ও বিরোধের আশঙ্কা বাড়তে পারে, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পরিচালনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া আদৌ কতটা যৌক্তিক?
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি সমুদ্রবন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নির্বিঘ্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে এই বন্দর অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এই বন্দর প্রতিবছর প্রায় তিন মিলিয়ন টিইইউ (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারের একক হিসাব) কনটেইনার হ্যান্ডল (পরিচালনা) করে।
■ বন্দরের কর্মদক্ষতা কেবল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে। ■ বিদেশি অপারেটর নিয়োগ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলি, সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করা আবশ্যক।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস যথার্থই চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে একে বাংলাদেশের ‘হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। হৃৎপিণ্ড সবল না হলে যেমন শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়, তেমনি এই বন্দর দুর্বল হলে দেশের অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটবে।
এখন প্রশ্ন আসে, এই ‘হৃৎপিণ্ড’ কে সবল রাখতে আমরা কোন পথ বেছে নেব? সঠিক জীবনযাপন ও স্বাস্থ৵বিধি মেনে শরীরচর্চা করে হৃৎপিণ্ডের সক্ষমতা বাড়াব, নাকি সহজ সমাধানের খোঁজে ‘বিদেশি দাওয়াইয়ের’ ওপর নির্ভর করব? আগেই বলা হয়েছে, সিদ্ধান্তটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত এবং এর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা জড়িত।
২.
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ২০০৭ সালে নির্মিত হয়, যার প্রাথমিক সক্ষমতা ছিল ১.১ মিলিয়ন টিইইউ। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সংযোজনের মাধ্যমে এটি আরও উন্নত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় টার্মিনালটি বছরে ১.৩ মিলিয়ন টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে, যা তার নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
এনসিটি প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে টার্মিনাল দেশীয় ব্যবস্থাপনায় সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং লাভজনকভাবে কাজ করছে, সেটি বিদেশি পরিচালনায় হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?
চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত বন্দর হলেও এর দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের (জাহাজের অপেক্ষার সময়) জন্য চট্টগ্রামে তিন–চার দিন অপেক্ষা করে, সেখানে সিঙ্গাপুরে এটি মাত্র ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা এবং কলম্বোয় ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়। একইভাবে কনটেইনার খালাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে, যা বিশ্বের শীর্ষ বন্দরে সাধারণত ২–৩ দিনের মধ্যে শেষ হয়; এর ফলে রপ্তানি ও আমদানির খরচ বেড়ে যায়।
বন্দরের কর্মদক্ষতা কেবল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর তীরে একটি সরু চ্যানেলে অবস্থিত, যেখানে পানির গভীরতা (ড্রাফট) প্রায় ৯ দশমিক ৫ মিটার যা আবার জোয়ার-ভাটার কারণে অনেক সময় কম-বেশি হয়।
পানির অগভীরতার পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল, তীক্ষ্ণ বাঁক ও জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন জাহাজ চলাচলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে জাহাজের ‘টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম’ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। অবস্থানগত সীমাবদ্ধতার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতাকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরের মানদণ্ডে সরাসরি মূল্যায়ন করা যৌক্তিক নয়।
প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও আধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেমের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। অবকাঠামো ও গুদাম ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পণ্য হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটায় আর শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি অপারেশনাল কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যালেঞ্জ কেবল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েই সীমাবদ্ধ নয়, এর কার্যকর সমাধানে প্রয়োজন কাস্টমস–প্রক্রিয়ার দ্রুততর ডিজিটালাইজেশন, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং গুদামজাতকরণ ও পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ।
৩.
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০২৩ সালে; সরকারের সঙ্গে সরকার (জিটুজি) আলোচনার মাধ্যমে। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্দর নিয়ে কেন একই নীতি অনুসরণ করছে?
বিষয়টি শুধু একটি সরকারের সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মতবাদ—‘নব উদারনৈতিক (নিউ লিবারেল) দর্শনের প্রতিফলন।’ এই দর্শনের লক্ষ্য হলো বাজারব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সরকারি সম্পদের বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর জন্য প্রবেশাধিকারের পথ উন্মুক্ত করা।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো এই দর্শন বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে চলেছে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে কৌশলগত খাতগুলোতে বেসরকারীকরণে উৎসাহ দিচ্ছে, যা অনেক সময় জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
একাধিক উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের চুক্তির পরিণতি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে; যেমন আফ্রিকার ছোট্ট দেশ জিবুতি ২০০৬ সালে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ‘ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল’ পরিচালনার জন্য ৫০ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল। শুরুতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ফলে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে। জবাবে ডিপি ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থায় মামলা করে এবং পরে ক্ষতিপূরণ দাবি করে জয়লাভও করে।
এ ধরনের উদাহরণ শুধু আফ্রিকায় নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতেও দেখা গেছে। যেমন ২০১৪ সালে কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দরের একটি টার্মিনাল চীনা কোম্পানি সিআরবিসিকে দিয়েছিল। শুরুতে রাজস্ব বাড়লেও পরে স্থানীয় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ কমে যায়। কারণ, চীনা কোম্পানিগুলো নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব অবকাঠামো প্রকল্পে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা বেসরকারীকরণ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি ও দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও কেনিয়ার মতো দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি কোম্পানিকে কৌশলগত খাতের নিয়ন্ত্রণ দিলে স্থানীয়দের ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা কমে যায়।
এ ছাড়া একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, কৌশলগত খাতে বেসরকারীকরণ টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি; বরং আয়বৈষম্য, শ্রমবাজার সংকোচন এবং সামাজিক অসন্তোষ বেড়েছে। ওইসিডির ২০২২ সালের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ছাড়া কৌশলগত সম্পদের বেসরকারীকরণ দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন ও দর–কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল করে।
৪.
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দক্ষতা বাড়ানোর একমাত্র উপায় কি বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়া? ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশেই নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল একটি সৌদি কোম্পানির অধীন পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক পাঁচ লাখ টিইইউ হ্যান্ডল করার কথা থাকলেও এক বছর পর গড় হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ শতাংশ। সেখানে এখনো পর্যাপ্ত গ্যান্ট্রি ক্রেন বসানো হয়নি এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল ও টার্মিনাল অটোমেশন গড়ে তোলা হয়নি। অনেকের মতে, ২০২৩ সালে সৌদি অপারেটরের সঙ্গে করা চুক্তিটি জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এ দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে, শুধু বিদেশি অপারেটর আনলেই দক্ষতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত হয় না। অবকাঠামো, জনবল ও সুশাসনের ঘাটতি থাকলে তারাও ব্যর্থ হয়। একই অভিজ্ঞতা আফ্রিকার মোমবাসা ও লাতিন আমেরিকার গুয়ায়াকিল বন্দরে দেখা গেছে; যেখানে বিদেশি পরিচালনা সেবার মান বাড়াতে পারেনি, বরং দুর্বল চুক্তি, শ্রমিক অসন্তোষ ও অতিরিক্ত খরচের মতো সমস্যা তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে সবচেয়ে দ্রুত, সহজ এবং স্বল্প ব্যয়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ হলো কাস্টমস সংস্কার। বর্তমানে একটি কনটেইনার ক্লিয়ারেন্সে গড়ে সাত দিন লাগে, অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটি এক–দুই দিনে সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স সূচক অনুযায়ী, কাস্টমস দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ দেশের মধ্যে ১০০তম; যা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আধুনিক স্ক্যানার, স্বয়ংক্রিয় রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ২৪/৭ অপারেশন ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া ছাড়াই বন্দরের সামগ্রিক স্থবিরতা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
৫.
এনসিটি পরিচালনা বিষয়ে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ইজারার শর্তাবলি এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এর ফলে চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি কিংবা কৌশলগত ঝুঁকি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করা দুরূহ। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগে বন্দরের দক্ষতা বাড়লেও কনটেইনার চার্জ বৃদ্ধি, শ্রমিক অধিকার সংকোচন, কৌশলগত তথ্যঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক বিরোধের আশঙ্কা বাড়ে।
বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বেসরকারীকরণে বন্দর পরিচালনার ব্যয় ২০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, বিদেশি অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে বন্দরের পরিচালনা সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে। ভারতের মুন্দ্রা ও শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরে বিদেশি অপারেশনের অধীন কনটেইনার চার্জ ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যবসায়িক ব্যয় ও প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে আর এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সমাধান শুধু বিদেশি অপারেটরের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুসমন্বিত বহুমাত্রিক রোডম্যাপ; যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া, অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক ব্যবস্থাপনা এবং পণ্য পরিবহন ও গুদামজাতকরণসহ সমগ্র লজিস্টিকস শৃঙ্খলকে আধুনিক ও কার্যকর করতে হবে একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলি, সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করা আবশ্যক। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হতে হবে খোলামেলা, অংশগ্রহণমূলক এবং
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে; যাতে দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে এ রকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
● গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা