সাতক্ষীরা ০৬:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ :

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব পবিত্র মোহনের সমাজচিন্তা

পিসিবার্তা ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৮:১৮:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অক্টোবর ২০২৩ ২৮০ বার পঠিত

নব্বুয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা, লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশের নেশা থেকে বন্ধুবর কবি গাজী শাহজাহান সিরাজের সাথে আমার প্রিয় শিক্ষক ফজলুর রহমান স্যারের (মরহুম) জাহান প্রেস এবং তাঁর ছোট ভাই ডাঃ মশিউর রহমানের শাপলা প্রেসে যাতায়াত শুরু করেছি। তখন শাপলা প্রেসে কম্পিউটার বসলেও (অপারেটর নলতার মিঠু) অফসেট প্রেস তখনও ঠিকঠাক রান হয়নি (শুরুটা মশিউর ভাই-ই করলেন,পলাশপোলে)। শাপলা প্রেসের ছোট্ট কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের রেস্ট্ররেন্ট এলাকায় ঢুকতে জাহান প্রেসের ভেতর দিয়ে উকিঝুকি মেরে পৌছানোর একটি বিকল্প শর্টকার্ট রাস্তা ছিলো। সময় বাঁচে, কিন্তু মুশকিল চোকপোস্টের শিওরে সংক্রান্তি (!); ক’জন সিনিয়র শিক্ষকের বৈঠকখানা (আড্ডা বলাই উত্তম)। সাথে আমার আদর্শ শিক্ষক অসিত কুমার মজুমদার (প্রয়ত) [তখনও শিক্ষকদের সম্ভ্রম করার রীতি চালু ছিল]। সেই নির্মল আড্ডায় এক-দু’জন বয়সে নবীন যুবককেও দেখতাম। তাঁদের মধ্যে গোলগাল চেহারার মানুষটির নাম জেনেছিলাম, পবিত্র বাবু। আজকের শিক্ষাবিদ, গবেষক, মানবাধিকার সংগঠক ও বিশিষ্ট সমাজহিতৈষী অধ্যক্ষ পবিত্র মোহন দাস। সম্ভ্রমে পাশকাটিয়ে যাওয়াই তখন চেকপোস্ট পেরুনের হাফ-টিকিট!

তারপর পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়ালেও প্রাণসায়েরের কৃপণতার তকমা বেশ চিকিচিক করতে শুরু করেছে। ওই প্রচণ্ড খরার ভেতরেই ভাষা সৈনিক আমানুল্লাহ স্যারের নেতৃত্বে মাধ্যমিক শিক্ষকদের সংগঠন বেড়ে ওঠার পালে ততদিনে বেশ জোরেই হাওয়া লেগেছে। ইউনুস স্যার, আশরাফ স্যারেরা তখন শিক্ষক নেতৃত্বের মধ্যগগণে। সে সময়ই (আমার যদি ভুল না হয়!) সাতক্ষীরার কলেজ শিক্ষকদের কল্যাণের ভ্রুণটি সবে ওম পেতে

ইসরোর চন্দ্রযান  আমার পবিত্র ভাবনা

শুরু করেছে। সেই জীবন বিকাশের সূতিকাগারে যে ক’জন কুশিলব নিউটনের আপেলের সূত্রকে পাশ কাটিয়ে ধাক্কামারার চর্চায় রত, বাবু পবিত্র মোহন দাশ তাঁদের অন্যতম। ওই মানুষটিকে কাছ থেকে জানার সুযোগ তখনও আমার বিশেষ হয় নি।

গত আগস্টের শেষ ভাগে যখন আমার স্ত্রী তপতীকে সাথে নিয়ে কেদারনাথ-বদ্রীনাথ দর্শনে বেরুনোর প্রস্তুতি শেষ করে ভারতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, অধ্যক্ষ ওহেদ স্যার পবিত্র দাদাকে নিয়ে কিছু লিখতে বললেন। ২৩ আগস্ট ২০২৩, ট্রেনের কামরায় সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় বসে লেখাটা কোথা থেকে শুরু করবো নিয়ে অস্থির, তখন একই সময়ে ভারতের চন্দ্রযান বিক্রমের চাঁদের মাটিতে ‘সফট ল্যান্ডিং‘-এর সরাসরি সম্প্রচার চলছে। ইন্টারনেট আর গণমাধ্যমের বদৌলতে ট্রেনের কামরায় বসে মহাকাশে চোখ রাখা যেন জল-ভাত। বিচিত্র অভিজ্ঞতা! উল্টো গণনা যতই কমছে, উত্তেজনার পারদ ততই চড়ছে। আর সঙ্গত করণেই পবিত্র স্যারকে নিয়ে আমার ভাবনা ক্রমেই মৃয়মান হতে হতে কখন অন্তর্হিত হলো বুঝতেই পারিনি। তা হলে, পবিত্র মোহন কি আমার জীবনে উপেক্ষাযোগ্য! তা কি বাস্তব নাকি সম্ভব! সেই থেকে কি এক অপরাধ বোধ আমাকে তাড়া করে ফিরছিলো সারাক্ষণ।

অবশেষে তেরো দিনের উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ শেষে যখন দেশে ফিরলাম, লেখায় হাত দিলেও কেন যেন শেষ, নাকি শুরুই করতে পারছিলাম না লেখাটা। এ কি স্মৃতিচারণ, নাকি জীবন্ত ইতিহাসের পোস্টমর্টেম- কোনটা? তালগোল লাগে যাচ্ছিল আমার ভাবনার উঠোনে। তখনই আশেক স্যারের লেখাটা সামনে আসায়, কিছুটা হলেও সাহস পেলাম। তাই তো কম্পিউটারের কী-বোর্ড সচল করা গেলো।

কাফেলা আঙিণায় পবিত্র বাবু

বিগত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে থেকে আমি বাসদ নামের বাম ঘরানার ছোট্ট রাজনৈতিক দলটির সক্রিয় কর্মী। অনেকটা বেপরোয়া মনোভাবের জন্য ইন্টার পাশের এক দশক পর ডিগ্রী পাশ এবং বিয়ে। ততদিনে সাতক্ষীরার প্রথম দৈনিক কাফেলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (মরহুম) আব্দুল মোতালেব সাহেবের বৈঠাকখানা একদম শুধু জমজমাটই নয়, ওভার-ফ্লো’র জো। এক সন্ধ্যায় আমিও যোগ দিলাম ওই ইন্দ্রসভায়। একটু বাদেই মোতালেব চাচার বাম পাশের কপাটহীন দরজার শ্রীহীন পর্দা গলিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, সেই মৃদুভাষী মানুষটি, আজকে সাতক্ষীরার ‘প্রবীনদের নিরাপদ ছত্রী’ পবিত্র মোহান দাশ। অল্প দিনেই আবার নতুন করে পরিচয় হলো, কলম সৈনিক পবিত্র বাবুর সাথে। তারপর কেমন করে যেন জড়িয়ে গেলাম কাফেলায়, বোনাস হিসেবে কলেজের চাকরী। কাফেলা চত্বরেই আরো পাঁচজনের মতো মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠক পবিত্র বাবুর সাথে আমার নৈকট্যলাভ।

পবিত্র বাবু তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদুভাষ্য অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সংকল্পে অটল পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব ক্রমেই আমার নমস্য অভিভাবক হয়ে উঠলেন। প্রসঙ্গত আর যে কয় জন ব্যক্তি আমাকে সমাজের একজন হয়ে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণ দিয়েছেন, পথ চলার ইন্দোন যুগিয়েছেন, দুর্দিনে মাথার ওপরে আশির্বাদের হাত রেখেছেন, অভিভাবকের মতো সুপরামর্শ দিয়েছেন- তাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও রোটারিয়ান বাবু ভূধর চন্দ্র সরকার, অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী, অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ এবং আমার শিক্ষাগুরু অধ্যক্ষ অসিত কুমার মজুমদার নাম স্মরণ করি।

 গবেষক পবিত্রবাবু

আশির দশকে ছাত্র-আন্দোলন আর এরশাদ বিরোধী মিছিলের একটা জোস ছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্বশীল কর্মী-সংগঠক হিসেবে কখনও কখনও একটু বেশী ঝুঁকি নিতেও হয়েছিল। ছাত্র-জনতার গণরোষে এরশাদশাহীর পতন হয়েছে ততদিনে। এরই মধ্যে মানবাধিকার সংগঠক হিসেবে অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাশ শুধু সাতক্ষীরা নয়, দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছে শুধু পরিচিত নয়, নির্ভরশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ, অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো, মাদকাসক্তি ও চোরাচালান রোধে প্রচারণা, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ, প্রতিটা ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান থেকে নিবীড় পরিচর্যার পাশাপাশি গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজে সর্বদা স্বচেষ্ট থেকেছেন পবিত্র বাবু।

একানব্বুয়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গদিতে আসীন। সারা দেশে নির্বাচনের হওয়া, সাথে নির্বাচন নিরপেক্ষ আর অংশ গ্রহণমূলক হওয়ার দাবীতে হাওয়া-গরম চারপাশে। মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের পক্ষে নির্বাচন মনিটরিং এর একটা গুরু দায়িত্ব নিলেন অধ্যাপক পবিত্র মোহস দাশ। তথ্য সংগ্রহের কর্মীবাহিনীতে আমিও সামিল হলাম। ওই যে আগেই বলেছি, তখনও রাজনীতিতে সক্রিয় আমি, তাই নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে কতটা নিরোপেক্ষ থাকতে পারবো, সংশয় ছিল পবিত্র বাবুর। আমি নির্মোহ দায়িত্ব পালনের সে পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম।। ওই সময় কাছ থেকে দেখলাম, পবিত্র বাবুর কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, সততা আর দায়িত্বশীলতার শাণিত কৃপান। পবিত্র মোহন দাশ সফল হলেন। তারপর একে একে আরো বেশ ক’টি গবেষণামূলক কাজ হাতে নিলেন, সফলও হলেন তিনি।

 শিশু সংগঠক পবিত্র মোহন

রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প ছুটি’তে যে বয়সের কিশোর-তরুণদের ‘বালাই’ বললেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পবিত্র মোহন দাশরা সেই শিশু-কিশোর তরুণদেরকে সমাজে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকায় দেখার স্বপ্ন লালন করছেন। শিশুশ্রম, শিশু-নির্যাতন, শিশু-পাচার, শিশুদের জন্য মানবাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে প্রচার, প্রতিরোধ ইত্যাদির মতো কাজে সরাসরি শিশুদের সম্পৃক্ত করে গড়ে তুলছেন নতুন নতুন নেটওয়ার্ক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিশু-কিশোরা প্রবল উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে পবিত্র মোহনকে সেন্টার করে। অনিবার্য হয়েই চলে এসেছিল শিশু সাংবাদিকতা, শিশু প্রতিনিধিত্বের মতো মহান অথচ শক্ত কাজটি। পবিত্র মোহনের নিবীড় পরিচর্যায় সাতক্ষীরার ক্ষুদে প্রতিনিধিরা জেলা-দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রতিনিধিত্ব করতে দমপেশ খায়নি।

 ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে পবিত্র বাবু

‘সততাই আমাদের ব্যবসার মূলধন’ কথাটা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক আগেই ভুলে গেছে। কোয়ালিটিহীন ভোগ্যপণ্য, নতুন মোড়কে পুরাতন (মেয়াদ উত্তীর্ণণ) সামগ্রী, অনুমোদন ছাড়াই কারখানাজাত দ্রব্য নিরীহ ভোক্তার হাতে তুলে দিতে তাদের হাত কাঁপে না। চটকদার মোড়কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জ্যাঙ্কফুডের রমরমা ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট। সাতচল্লিশের মনন্তর কিম্বা তেয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় ‘চালে কাঁকর’ মেশানোর কথা শুনতাম। কিন্তু শিশুখাদ্য গুড়োদুধে ম্যালামাইন পাউডার মেশানোর কথা শুনতে বিশ্বাস কমতে মন চায় না আমাদের। তবুও সবই হয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মোড়কে ময়দা, একটু হাস্যকর মনে হলেও সত্য! সমাজে যখন পুঁজিই চালিকা শক্তি, তখন লাভ ও লোভের যুপকাষ্ঠে বলি মূল্যবোধ; মানবিকতা লজ্জ্বায় মুখ লুকায়। সততা তো অনেক আগেই ব্যকডেটেড হয়ে গেছে। তাই তো পবিত্র বাবুদের অনিবার্য হয়ে উঠেছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে। পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক ব্যবসার লাগাম টানার জন্য মাঠে নামতে হয় পবিত্র-আশেক পরিত্রাণের ভূমিকায়।

ভোক্তাদেরও যে অধিকার আছে জবাব চাওয়ার, সে কথা সবার ঘরে ঘরে পৌছে দেয়ার অমোঘ দায়িত্ব অম্লাণ বদনে তুলে নিতে দেখেছি পবিত্র মোহনেদের। তাঁদের দ্বীপ্ত পদচারণায় সম্বিত ফিরেছে সরকারের, সংশ্লিষ্ট মহলের। তৈরী হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আইন, প্রয়োগকারী যথাযথ কতৃপক্ষ। ক্রিয়াশীল সনাক, সাতক্ষীরা। অভিনন্দন আশোক ভাই, পবিত্র দাদা!

শিক্ষক নেতা পবিত্র মোহন ও জিরোপেইন

জাহান প্রেসের আড্ডা থেকে শিক্ষকদের অবহেলা-বঞ্চনা-অধিকারহীনতার বিষয়টি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল পবিত্রবাবুর (আমার দেখা)। সেই থেকেই শিক্ষক আন্দোলনে সাথে থাকার নীতিগত অবস্থান নিতে শুরু করেন পবিত্রবাবু। তখনও বাকশিসের নিজস্ব কোন কার্যালয় ছিল না, সাংগঠনিক কাঠমোও নড়বড়ে। তখনই আশেক স্যার, মইনুল ভাই, ছোট ভাই জ্যোতি (স্যার)কে সামনে রেখে সংগঠন পুনঃগঠনের উদ্যোগ নেয় যে শিক্ষক সমাজ, অন্তরালে অনুঘটকের ভূমিকায় অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন, অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাশ। প্রকাশ্য নেতৃত্ব দেয়ার অনিহা থেকে যে মানুষটি সাজঘরে বসে তৈরী করছিলেন কুশি-লবদের, সকলের অনুরোধে অবশেষে নেতৃত্ব তাঁকে নিতেই হলো। আর সেই দায়বোধ আর শিক্ষকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে জাহান প্রেসের পেছনের মার্কেট-ভবনের তিন তলায় বাকশিস অফিস নেয়া হলো। পাশেই পবিত্র বাবুর জিরোপেইন ক্লাব অফিস। জেলার শিক্ষদের কাছে জিরোপেইন আর বাকশিস অফিস অনেকটা সমার্থক শব্দ হয়ে উঠলো।

পবিত্র মোহন দাশের অকুণ্ঠ পরিচর্যায় বাকশিস অফিসে ততদিনে কল্যান সমিতি চলতে শুরু করেছে। সমান তালে অবসরের সাহসী সাথী জিরোপেইন ক্লাব। সভ্যসাচী সংগঠক পবিত্র মোহান দু’জায়গাতেই সফল। মানুষের পাশে থাকার যে হৃদয়ব্রত, সমাজচিন্তা, পবিত্র মোহনকে দিনে দিনে পরীক্ষিত ও পরিশিলিত করে তুলেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যাঁরা পাশে ছিলেন, এ অবসরে তাঁদেরকেও সেলুট জানাই।

সকাল কম্পিউটার পবিত্র মোহন

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ বছরে (১৯৯৯) অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী স্যারের সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রগতি নেটের অন্দরে  যে প্রগতি মাল্টিমিডিয়া নামের কম্পিউটার স্কুলটি খেলা হয়েছিল, সেটিই কালক্রমে সকাল কম্পিউটিং একাডেমী হয়ে ২০০৩ সাথে সকাল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার নামে জেলার প্রথম স্বতন্ত্র কম্পিউটার প্রশিক্ষাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে। তার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে বাবু ভূধর চন্দ্র সরকারের সাথে আমাদের প্রিয় পবিত্র মোহন দাশ আমার পাশে অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়েছিলেন, অদ্যাবধি সে অনবদ্য দায়িত্বটি পালন করে চলেছেন দ্বিধাহীনচিত্তে। তাঁদের মতো মানুষকে সাথে পেয়েছিলাম বলে, সে দিনের ‘সেই ভ্রণটি আজ মহিরুহ’ বললে অত্যোক্তি হবে না মোটেও। তিন মাস, ছয় মাসে গণ্ডি পেরিয়ে এখন সেখানে এক বছর মেয়াদি পোস্ট-গ্রাজুয়েট স্তরের চারুকলা ও আইসিটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

চারুকলার প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্ততি যখন প্রায় সম্পন্ন, তখনই প্রতিটা সমাপনী অনুষ্ঠানে শত ব্যস্ততার ভেতরেও উপস্থিত ‘মডিফিকেশন পরামর্শ দিয়ে আসছেন অধ্যক্ষ পবিত্র মোহন দাশ। সকাল কম্পিউটার পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে নিরন্তর কৃতজ্ঞতা, বিনম্র শ্রদ্ধা আর হার্দিক অভিবাদন।

পারিবারিক বান্ধব সুহৃদ পবিত্র দাদা

তখন মনজিতপুরের ‘টালীসেডে’র কাছেই থাকি। জীবন সংগ্রামে প্রতিদিন নতুন নতুন মাত্র যোগ হচ্ছে। ঠিক একই সময়ে পড়ালেখায় অমনোযোগী আমার ছেলে সকালকে নিয়ে বেশ চিন্তার ভাজ পড়ছে কপালে। অনেকটা বিভ্রান্ত তখন আমি। তখনই পরম বান্ধবের মতো পাশে দাঁড়ালেন পবিত্র দাদা আর রঞ্জিতা বৌদি। সকালকে গড়াপেটার কঠিন দায়িত্ব অম্লান বদনে কাঁধে তুলে নিলেন এই দাশ-দম্পতি। আমি এবং আমার পরিবার চির কৃতজ্ঞ পবিত্র মোহনের কাছে, যার স্নেহের পরশ মাথায় ওপরে না থাকলে আমাদের ছেলের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া দূরহ ও সুদূর পরাহত ছিল। সাথে অনিন্দ-উৎসবকে স্মরণ করি, ওদের সাহস ও সাহোচার্য না পেলে সকাল হয়তো মাথা উঁচুকরে দাঁড়ানোর সাহসই পেতো না।

গণিতের কুরিদম্পতি পবিত্ররঞ্জিতা

দুই সন্তান আর স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার পবিত্র-রঞ্জিতা দম্পতির। একালের কুরি-দম্পতি আমাদের গণিতজ্ঞ দাশ-দম্পতি।  জীবনের হিসেবের খাতায় তাঁরা দশে দশ! তাঁদের দু’টি সন্তানই আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। ওদের একজন অনন্দি দাশ সৌরভ চিকিৎসক, অন্য জন অভিষকে দাশ উৎসব প্রকৌশলী। আমাদের নিরন্তর স্নোহাশীষ আর শুভ কামনা তাদের জন্য।

– নিত্যানন্দ সরকার, সাতক্ষীরা, ০৫ অক্টোবর ২০২৩।

ট্যাগস :

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব পবিত্র মোহনের সমাজচিন্তা

আপডেট সময় : ০৮:১৮:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অক্টোবর ২০২৩

নব্বুয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা, লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশের নেশা থেকে বন্ধুবর কবি গাজী শাহজাহান সিরাজের সাথে আমার প্রিয় শিক্ষক ফজলুর রহমান স্যারের (মরহুম) জাহান প্রেস এবং তাঁর ছোট ভাই ডাঃ মশিউর রহমানের শাপলা প্রেসে যাতায়াত শুরু করেছি। তখন শাপলা প্রেসে কম্পিউটার বসলেও (অপারেটর নলতার মিঠু) অফসেট প্রেস তখনও ঠিকঠাক রান হয়নি (শুরুটা মশিউর ভাই-ই করলেন,পলাশপোলে)। শাপলা প্রেসের ছোট্ট কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের রেস্ট্ররেন্ট এলাকায় ঢুকতে জাহান প্রেসের ভেতর দিয়ে উকিঝুকি মেরে পৌছানোর একটি বিকল্প শর্টকার্ট রাস্তা ছিলো। সময় বাঁচে, কিন্তু মুশকিল চোকপোস্টের শিওরে সংক্রান্তি (!); ক’জন সিনিয়র শিক্ষকের বৈঠকখানা (আড্ডা বলাই উত্তম)। সাথে আমার আদর্শ শিক্ষক অসিত কুমার মজুমদার (প্রয়ত) [তখনও শিক্ষকদের সম্ভ্রম করার রীতি চালু ছিল]। সেই নির্মল আড্ডায় এক-দু’জন বয়সে নবীন যুবককেও দেখতাম। তাঁদের মধ্যে গোলগাল চেহারার মানুষটির নাম জেনেছিলাম, পবিত্র বাবু। আজকের শিক্ষাবিদ, গবেষক, মানবাধিকার সংগঠক ও বিশিষ্ট সমাজহিতৈষী অধ্যক্ষ পবিত্র মোহন দাস। সম্ভ্রমে পাশকাটিয়ে যাওয়াই তখন চেকপোস্ট পেরুনের হাফ-টিকিট!

তারপর পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়ালেও প্রাণসায়েরের কৃপণতার তকমা বেশ চিকিচিক করতে শুরু করেছে। ওই প্রচণ্ড খরার ভেতরেই ভাষা সৈনিক আমানুল্লাহ স্যারের নেতৃত্বে মাধ্যমিক শিক্ষকদের সংগঠন বেড়ে ওঠার পালে ততদিনে বেশ জোরেই হাওয়া লেগেছে। ইউনুস স্যার, আশরাফ স্যারেরা তখন শিক্ষক নেতৃত্বের মধ্যগগণে। সে সময়ই (আমার যদি ভুল না হয়!) সাতক্ষীরার কলেজ শিক্ষকদের কল্যাণের ভ্রুণটি সবে ওম পেতে

ইসরোর চন্দ্রযান  আমার পবিত্র ভাবনা

শুরু করেছে। সেই জীবন বিকাশের সূতিকাগারে যে ক’জন কুশিলব নিউটনের আপেলের সূত্রকে পাশ কাটিয়ে ধাক্কামারার চর্চায় রত, বাবু পবিত্র মোহন দাশ তাঁদের অন্যতম। ওই মানুষটিকে কাছ থেকে জানার সুযোগ তখনও আমার বিশেষ হয় নি।

গত আগস্টের শেষ ভাগে যখন আমার স্ত্রী তপতীকে সাথে নিয়ে কেদারনাথ-বদ্রীনাথ দর্শনে বেরুনোর প্রস্তুতি শেষ করে ভারতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, অধ্যক্ষ ওহেদ স্যার পবিত্র দাদাকে নিয়ে কিছু লিখতে বললেন। ২৩ আগস্ট ২০২৩, ট্রেনের কামরায় সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় বসে লেখাটা কোথা থেকে শুরু করবো নিয়ে অস্থির, তখন একই সময়ে ভারতের চন্দ্রযান বিক্রমের চাঁদের মাটিতে ‘সফট ল্যান্ডিং‘-এর সরাসরি সম্প্রচার চলছে। ইন্টারনেট আর গণমাধ্যমের বদৌলতে ট্রেনের কামরায় বসে মহাকাশে চোখ রাখা যেন জল-ভাত। বিচিত্র অভিজ্ঞতা! উল্টো গণনা যতই কমছে, উত্তেজনার পারদ ততই চড়ছে। আর সঙ্গত করণেই পবিত্র স্যারকে নিয়ে আমার ভাবনা ক্রমেই মৃয়মান হতে হতে কখন অন্তর্হিত হলো বুঝতেই পারিনি। তা হলে, পবিত্র মোহন কি আমার জীবনে উপেক্ষাযোগ্য! তা কি বাস্তব নাকি সম্ভব! সেই থেকে কি এক অপরাধ বোধ আমাকে তাড়া করে ফিরছিলো সারাক্ষণ।

অবশেষে তেরো দিনের উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ শেষে যখন দেশে ফিরলাম, লেখায় হাত দিলেও কেন যেন শেষ, নাকি শুরুই করতে পারছিলাম না লেখাটা। এ কি স্মৃতিচারণ, নাকি জীবন্ত ইতিহাসের পোস্টমর্টেম- কোনটা? তালগোল লাগে যাচ্ছিল আমার ভাবনার উঠোনে। তখনই আশেক স্যারের লেখাটা সামনে আসায়, কিছুটা হলেও সাহস পেলাম। তাই তো কম্পিউটারের কী-বোর্ড সচল করা গেলো।

কাফেলা আঙিণায় পবিত্র বাবু

বিগত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে থেকে আমি বাসদ নামের বাম ঘরানার ছোট্ট রাজনৈতিক দলটির সক্রিয় কর্মী। অনেকটা বেপরোয়া মনোভাবের জন্য ইন্টার পাশের এক দশক পর ডিগ্রী পাশ এবং বিয়ে। ততদিনে সাতক্ষীরার প্রথম দৈনিক কাফেলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (মরহুম) আব্দুল মোতালেব সাহেবের বৈঠাকখানা একদম শুধু জমজমাটই নয়, ওভার-ফ্লো’র জো। এক সন্ধ্যায় আমিও যোগ দিলাম ওই ইন্দ্রসভায়। একটু বাদেই মোতালেব চাচার বাম পাশের কপাটহীন দরজার শ্রীহীন পর্দা গলিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, সেই মৃদুভাষী মানুষটি, আজকে সাতক্ষীরার ‘প্রবীনদের নিরাপদ ছত্রী’ পবিত্র মোহান দাশ। অল্প দিনেই আবার নতুন করে পরিচয় হলো, কলম সৈনিক পবিত্র বাবুর সাথে। তারপর কেমন করে যেন জড়িয়ে গেলাম কাফেলায়, বোনাস হিসেবে কলেজের চাকরী। কাফেলা চত্বরেই আরো পাঁচজনের মতো মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠক পবিত্র বাবুর সাথে আমার নৈকট্যলাভ।

পবিত্র বাবু তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদুভাষ্য অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সংকল্পে অটল পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব ক্রমেই আমার নমস্য অভিভাবক হয়ে উঠলেন। প্রসঙ্গত আর যে কয় জন ব্যক্তি আমাকে সমাজের একজন হয়ে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণ দিয়েছেন, পথ চলার ইন্দোন যুগিয়েছেন, দুর্দিনে মাথার ওপরে আশির্বাদের হাত রেখেছেন, অভিভাবকের মতো সুপরামর্শ দিয়েছেন- তাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও রোটারিয়ান বাবু ভূধর চন্দ্র সরকার, অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী, অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ এবং আমার শিক্ষাগুরু অধ্যক্ষ অসিত কুমার মজুমদার নাম স্মরণ করি।

 গবেষক পবিত্রবাবু

আশির দশকে ছাত্র-আন্দোলন আর এরশাদ বিরোধী মিছিলের একটা জোস ছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্বশীল কর্মী-সংগঠক হিসেবে কখনও কখনও একটু বেশী ঝুঁকি নিতেও হয়েছিল। ছাত্র-জনতার গণরোষে এরশাদশাহীর পতন হয়েছে ততদিনে। এরই মধ্যে মানবাধিকার সংগঠক হিসেবে অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাশ শুধু সাতক্ষীরা নয়, দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছে শুধু পরিচিত নয়, নির্ভরশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ, অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো, মাদকাসক্তি ও চোরাচালান রোধে প্রচারণা, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ, প্রতিটা ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান থেকে নিবীড় পরিচর্যার পাশাপাশি গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজে সর্বদা স্বচেষ্ট থেকেছেন পবিত্র বাবু।

একানব্বুয়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গদিতে আসীন। সারা দেশে নির্বাচনের হওয়া, সাথে নির্বাচন নিরপেক্ষ আর অংশ গ্রহণমূলক হওয়ার দাবীতে হাওয়া-গরম চারপাশে। মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের পক্ষে নির্বাচন মনিটরিং এর একটা গুরু দায়িত্ব নিলেন অধ্যাপক পবিত্র মোহস দাশ। তথ্য সংগ্রহের কর্মীবাহিনীতে আমিও সামিল হলাম। ওই যে আগেই বলেছি, তখনও রাজনীতিতে সক্রিয় আমি, তাই নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে কতটা নিরোপেক্ষ থাকতে পারবো, সংশয় ছিল পবিত্র বাবুর। আমি নির্মোহ দায়িত্ব পালনের সে পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম।। ওই সময় কাছ থেকে দেখলাম, পবিত্র বাবুর কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা, সততা আর দায়িত্বশীলতার শাণিত কৃপান। পবিত্র মোহন দাশ সফল হলেন। তারপর একে একে আরো বেশ ক’টি গবেষণামূলক কাজ হাতে নিলেন, সফলও হলেন তিনি।

 শিশু সংগঠক পবিত্র মোহন

রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁর ছোটগল্প ছুটি’তে যে বয়সের কিশোর-তরুণদের ‘বালাই’ বললেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পবিত্র মোহন দাশরা সেই শিশু-কিশোর তরুণদেরকে সমাজে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকায় দেখার স্বপ্ন লালন করছেন। শিশুশ্রম, শিশু-নির্যাতন, শিশু-পাচার, শিশুদের জন্য মানবাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে প্রচার, প্রতিরোধ ইত্যাদির মতো কাজে সরাসরি শিশুদের সম্পৃক্ত করে গড়ে তুলছেন নতুন নতুন নেটওয়ার্ক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিশু-কিশোরা প্রবল উৎসাহ নিয়ে কাজ করছে পবিত্র মোহনকে সেন্টার করে। অনিবার্য হয়েই চলে এসেছিল শিশু সাংবাদিকতা, শিশু প্রতিনিধিত্বের মতো মহান অথচ শক্ত কাজটি। পবিত্র মোহনের নিবীড় পরিচর্যায় সাতক্ষীরার ক্ষুদে প্রতিনিধিরা জেলা-দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রতিনিধিত্ব করতে দমপেশ খায়নি।

 ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে পবিত্র বাবু

‘সততাই আমাদের ব্যবসার মূলধন’ কথাটা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক আগেই ভুলে গেছে। কোয়ালিটিহীন ভোগ্যপণ্য, নতুন মোড়কে পুরাতন (মেয়াদ উত্তীর্ণণ) সামগ্রী, অনুমোদন ছাড়াই কারখানাজাত দ্রব্য নিরীহ ভোক্তার হাতে তুলে দিতে তাদের হাত কাঁপে না। চটকদার মোড়কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জ্যাঙ্কফুডের রমরমা ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট। সাতচল্লিশের মনন্তর কিম্বা তেয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় ‘চালে কাঁকর’ মেশানোর কথা শুনতাম। কিন্তু শিশুখাদ্য গুড়োদুধে ম্যালামাইন পাউডার মেশানোর কথা শুনতে বিশ্বাস কমতে মন চায় না আমাদের। তবুও সবই হয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মোড়কে ময়দা, একটু হাস্যকর মনে হলেও সত্য! সমাজে যখন পুঁজিই চালিকা শক্তি, তখন লাভ ও লোভের যুপকাষ্ঠে বলি মূল্যবোধ; মানবিকতা লজ্জ্বায় মুখ লুকায়। সততা তো অনেক আগেই ব্যকডেটেড হয়ে গেছে। তাই তো পবিত্র বাবুদের অনিবার্য হয়ে উঠেছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে। পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক ব্যবসার লাগাম টানার জন্য মাঠে নামতে হয় পবিত্র-আশেক পরিত্রাণের ভূমিকায়।

ভোক্তাদেরও যে অধিকার আছে জবাব চাওয়ার, সে কথা সবার ঘরে ঘরে পৌছে দেয়ার অমোঘ দায়িত্ব অম্লাণ বদনে তুলে নিতে দেখেছি পবিত্র মোহনেদের। তাঁদের দ্বীপ্ত পদচারণায় সম্বিত ফিরেছে সরকারের, সংশ্লিষ্ট মহলের। তৈরী হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আইন, প্রয়োগকারী যথাযথ কতৃপক্ষ। ক্রিয়াশীল সনাক, সাতক্ষীরা। অভিনন্দন আশোক ভাই, পবিত্র দাদা!

শিক্ষক নেতা পবিত্র মোহন ও জিরোপেইন

জাহান প্রেসের আড্ডা থেকে শিক্ষকদের অবহেলা-বঞ্চনা-অধিকারহীনতার বিষয়টি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল পবিত্রবাবুর (আমার দেখা)। সেই থেকেই শিক্ষক আন্দোলনে সাথে থাকার নীতিগত অবস্থান নিতে শুরু করেন পবিত্রবাবু। তখনও বাকশিসের নিজস্ব কোন কার্যালয় ছিল না, সাংগঠনিক কাঠমোও নড়বড়ে। তখনই আশেক স্যার, মইনুল ভাই, ছোট ভাই জ্যোতি (স্যার)কে সামনে রেখে সংগঠন পুনঃগঠনের উদ্যোগ নেয় যে শিক্ষক সমাজ, অন্তরালে অনুঘটকের ভূমিকায় অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন, অধ্যাপক পবিত্র মোহন দাশ। প্রকাশ্য নেতৃত্ব দেয়ার অনিহা থেকে যে মানুষটি সাজঘরে বসে তৈরী করছিলেন কুশি-লবদের, সকলের অনুরোধে অবশেষে নেতৃত্ব তাঁকে নিতেই হলো। আর সেই দায়বোধ আর শিক্ষকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে জাহান প্রেসের পেছনের মার্কেট-ভবনের তিন তলায় বাকশিস অফিস নেয়া হলো। পাশেই পবিত্র বাবুর জিরোপেইন ক্লাব অফিস। জেলার শিক্ষদের কাছে জিরোপেইন আর বাকশিস অফিস অনেকটা সমার্থক শব্দ হয়ে উঠলো।

পবিত্র মোহন দাশের অকুণ্ঠ পরিচর্যায় বাকশিস অফিসে ততদিনে কল্যান সমিতি চলতে শুরু করেছে। সমান তালে অবসরের সাহসী সাথী জিরোপেইন ক্লাব। সভ্যসাচী সংগঠক পবিত্র মোহান দু’জায়গাতেই সফল। মানুষের পাশে থাকার যে হৃদয়ব্রত, সমাজচিন্তা, পবিত্র মোহনকে দিনে দিনে পরীক্ষিত ও পরিশিলিত করে তুলেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যাঁরা পাশে ছিলেন, এ অবসরে তাঁদেরকেও সেলুট জানাই।

সকাল কম্পিউটার পবিত্র মোহন

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ বছরে (১৯৯৯) অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী স্যারের সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রগতি নেটের অন্দরে  যে প্রগতি মাল্টিমিডিয়া নামের কম্পিউটার স্কুলটি খেলা হয়েছিল, সেটিই কালক্রমে সকাল কম্পিউটিং একাডেমী হয়ে ২০০৩ সাথে সকাল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার নামে জেলার প্রথম স্বতন্ত্র কম্পিউটার প্রশিক্ষাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে। তার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে বাবু ভূধর চন্দ্র সরকারের সাথে আমাদের প্রিয় পবিত্র মোহন দাশ আমার পাশে অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়েছিলেন, অদ্যাবধি সে অনবদ্য দায়িত্বটি পালন করে চলেছেন দ্বিধাহীনচিত্তে। তাঁদের মতো মানুষকে সাথে পেয়েছিলাম বলে, সে দিনের ‘সেই ভ্রণটি আজ মহিরুহ’ বললে অত্যোক্তি হবে না মোটেও। তিন মাস, ছয় মাসে গণ্ডি পেরিয়ে এখন সেখানে এক বছর মেয়াদি পোস্ট-গ্রাজুয়েট স্তরের চারুকলা ও আইসিটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

চারুকলার প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্ততি যখন প্রায় সম্পন্ন, তখনই প্রতিটা সমাপনী অনুষ্ঠানে শত ব্যস্ততার ভেতরেও উপস্থিত ‘মডিফিকেশন পরামর্শ দিয়ে আসছেন অধ্যক্ষ পবিত্র মোহন দাশ। সকাল কম্পিউটার পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে নিরন্তর কৃতজ্ঞতা, বিনম্র শ্রদ্ধা আর হার্দিক অভিবাদন।

পারিবারিক বান্ধব সুহৃদ পবিত্র দাদা

তখন মনজিতপুরের ‘টালীসেডে’র কাছেই থাকি। জীবন সংগ্রামে প্রতিদিন নতুন নতুন মাত্র যোগ হচ্ছে। ঠিক একই সময়ে পড়ালেখায় অমনোযোগী আমার ছেলে সকালকে নিয়ে বেশ চিন্তার ভাজ পড়ছে কপালে। অনেকটা বিভ্রান্ত তখন আমি। তখনই পরম বান্ধবের মতো পাশে দাঁড়ালেন পবিত্র দাদা আর রঞ্জিতা বৌদি। সকালকে গড়াপেটার কঠিন দায়িত্ব অম্লান বদনে কাঁধে তুলে নিলেন এই দাশ-দম্পতি। আমি এবং আমার পরিবার চির কৃতজ্ঞ পবিত্র মোহনের কাছে, যার স্নেহের পরশ মাথায় ওপরে না থাকলে আমাদের ছেলের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া দূরহ ও সুদূর পরাহত ছিল। সাথে অনিন্দ-উৎসবকে স্মরণ করি, ওদের সাহস ও সাহোচার্য না পেলে সকাল হয়তো মাথা উঁচুকরে দাঁড়ানোর সাহসই পেতো না।

গণিতের কুরিদম্পতি পবিত্ররঞ্জিতা

দুই সন্তান আর স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার পবিত্র-রঞ্জিতা দম্পতির। একালের কুরি-দম্পতি আমাদের গণিতজ্ঞ দাশ-দম্পতি।  জীবনের হিসেবের খাতায় তাঁরা দশে দশ! তাঁদের দু’টি সন্তানই আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। ওদের একজন অনন্দি দাশ সৌরভ চিকিৎসক, অন্য জন অভিষকে দাশ উৎসব প্রকৌশলী। আমাদের নিরন্তর স্নোহাশীষ আর শুভ কামনা তাদের জন্য।

– নিত্যানন্দ সরকার, সাতক্ষীরা, ০৫ অক্টোবর ২০২৩।